Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus

টাকা জোগাড় কঠিন হবে না

আগে বলি, অর্থসংস্থান পাওয়া সম্ভব কী উপায়ে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো অনেক রকম ভর্তুকি দেয়।

প্রণব বর্ধন
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২০ ০০:৫৭
Share: Save:

সঙ্কটকালের মোকাবিলা হিসেবে নয়, ন্যূনতম আয় চালু করা আসলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার হিসেবে ভাবা উচিত, এই আলোচনা করেছি গতকাল (‘দানসামগ্রী, না কি অধিকার’, পৃ ৪, ২৩-৬)। এ বার বলি, অর্থের জোগান একটা বড় সমস্যা হলেও দরিদ্র দেশগুলোতে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম আয় দেওয়া সাধ্যাতীত হবে না। ভারতের ন্যূনতম আয়ের জন্য কত টাকা লাগবে, আমি একটা হিসেব কষেছি।

আগে বলি, অর্থসংস্থান পাওয়া সম্ভব কী উপায়ে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো অনেক রকম ভর্তুকি দেয়। তার মধ্যে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জলের ব্যবস্থা, নিকাশি, আবাসন, নগর উন্নয়ন এগুলো স্বল্পবিত্ত মানুষের জন্য জরুরি। কিন্তু ভর্তুকির বেশিটাই যায় তুলনায় সচ্ছল মানুষের কাছে। এই ধরনের অদরকারি ভর্তুকির জন্য জিডিপি-র ৫.৭ শতাংশ খরচ হয়েছিল ২০১৫-১৬ সালে।

এ ছাড়া ব্যবসায়িক সংস্থাকে কর মকুব ও অন্যান্য যে সব ছাড় দেওয়া হয়, সেগুলি জিডিপি-র পাঁচ শতাংশ। এর মধ্যে কয়েক ধরনের শুল্ক মাফ করা হয়তো এড়ানো সম্ভব নয়, কিন্তু অন্য কিছু ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনীয়তা অতটা স্পষ্ট নয়। যেমন, বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকায় কর মকুব না করলে ওই বিনিয়োগ হয়তো অন্যত্র হত। এই সব ছাড়ের অন্তত অর্ধেক, অর্থাৎ জিডিপি-র আড়াই শতাংশ, আরও ভাল কোনও কাজে লাগানো যেতে পারে। এই হিসেবে রাজ্য সরকারের রাজস্ব ছাড়ের পরিমাণ ধরা নেই, কারণ তার কোনও ভাল পরিসংখ্যান নেই।

নতুন কর বসানোরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ভারতের কর ও জিডিপির যে অনুপাত, চিন, ব্রাজিল এবং অন্য বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে তা কম। ভারতে আবাসন সম্পত্তি এবং নগর অঞ্চলে জমির উপর বাজার মূল্যের তুলনায় কর অত্যন্ত কম ধার্য করা হয়, তাতে কারচুপিও থাকে। এ ছাড়াও অন্য সম্পদ, উত্তরাধিকার এবং কৃষি-আয়ে কোনও কর নেওয়া হয় না। অথচ পারিবারিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে, ভারতে সম্পদ বণ্টনের অসাম্য আরও চড়া হচ্ছে, এখন তা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোয় অসাম্যের হারের কাছাকাছি। জিডিপি-র ১.৮ শতাংশ বাড়তি কর থেকে পাওয়া যাবে বলে আমরা ধরছি।

এই সবটা ধরলে জিডিপি-র অন্তত ১০ শতাংশ পাওয়া যাবে। প্রশ্ন উঠবে, ওই টাকা দিয়ে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিকাঠামোর উন্নতি হবে না কেন? এই তিনটি বিষয় সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। যদি ধরে নেওয়া যায় যে এই তিনটি বিষয় এবং ন্যূনতম আয়ের জন্য সমান ভাবে ভাগ করে নেওয়া যাবে ওই ১০ শতাংশ টাকা, তা হলে ন্যূনতম আয়ের জন্য অন্তত আড়াই শতাংশ পাওয়া যাবে। এতে প্রতি বছর মাথাপিছু প্রায় চার হাজার টাকা (অর্থাৎ পরিবার পিছু কুড়ি হাজার টাকা)ন্যূনতম আয় দেওয়া যাবে। ভারতের প্রেক্ষিতে এটা খুব খারাপ নয়। লক্ষণীয় যে বর্তমানে গরিবদের জন্য যে প্রকল্পগুলি চালু রয়েছে, সেগুলোতে বিন্দুমাত্র হাত না দিয়েই এই টাকাটা পাওয়া যাবে। যদি কোনও চালু প্রকল্পের অপচয় কমানো যায়, প্রকল্পের বিকল্প ভাবা যায়, তা হলে যে টাকা বাঁচানো যাবে, তাতে মোট হিসেবে জিডিপি-র দশ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। (গত নির্বাচনের আগে মোদী সরকার কৃষকদের জন্য যে অনুদান ঘোষণা করেন, সেই টাকাটা এর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কেননা শুধু কৃষকরা অনুদান পাবেন, অথচ বর্গাদার, খেতমজুর, অ-কৃষক শ্রমিক বা অন্য খেটে-খাওয়া মানুষ কেন পাবেন না, এর বিশেষ যৌক্তিকতা নেই)।

আমি ভালই জানি যে সব ভর্তুকি দীর্ঘ দিন চালু রয়েছে তা বাদ দেওয়া, কিংবা নতুন কর চাপানো, কোনওটাই রাজনৈতিক ভাবে সহজ হবে না। নানা কায়েমি গোষ্ঠীর থেকে প্রতিরোধ আসবে। কিন্তু এ-ও ঠিক যে সঙ্কটের সময়ে এ ধরনের প্রতিরোধের ধার অনেকটা কমে আসে। তাই বড় সংস্কারের জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। যদি জিডিপি-র দশ শতাংশ বার করা কঠিন হয়, তবে তার অর্ধেক নিয়ে শুধু মহিলাদের জন্য ন্যূনতম আয়ের প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে।

তার পরেও প্রকল্পের কার্যনির্বাহে অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে অনুদানের অঙ্ক বাঁধা থাকা উচিত কি না; যাঁদের পক্ষে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নাগাল পাওয়া সহজ নয় তাঁদের কী হবে— এগুলো প্রধানত রূপায়ণের সমস্যা। যদি ন্যূনতম আয়ের ধারণাটা নীতি-প্রণেতারা গ্রহণ করেন, তা হলে এ সব সমস্যার সমাধানে নানা ধরনের নমনীয় উপায় নেওয়া যেতে পারে। যেমন অনেকে মনে করেন, ন্যূনতম আয় জিডিপি-র একটি অংশ হওয়া উচিত, কোনও নির্দিষ্ট অঙ্ক নয়। তা হলে জিডিপি-র বৃদ্ধি ভাল হলে ন্যূনতম আয়ের অঙ্কটাও ভাল হবে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে অনুদানের মূল্য হ্রাসের সমস্যাও এড়ানো যাবে। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট না থাকার সমস্যা এড়াতে প্রান্তিক এলাকায় ব্যাঙ্কের এজেন্টদের মাধ্যমে বা ডাকঘর মারফত মানি-অর্ডারের মাধ্যমে, অথবা মোবাইল ব্যাঙ্কিং-এর সাহায্যে করা সম্ভব।

গত দেড় দশকে বেশ ধাক্কা লেগেছে বিশ্বের অর্থনীতিতে। আর্থিক সঙ্কট, ব্যয়সঙ্কোচ নীতি, বড় হারে ছাঁটাই, প্রযুক্তির পরিবর্তনের ঝাপটা, স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের উত্থান, জাতীয়তাবাদের বাড়াবাড়ি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, কৃষিতে পরিবেশ সংক্রান্ত সঙ্কট, উদ্বাস্তু-সমস্যা এবং পর পর মহামারি। কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় নিরাপত্তার অভাব ভয়ানক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সমস্যা আরও তীব্র, কারণ সুসময়েও এখানকার মানুষ দিন-আনি দিন-খাই পরিস্থিতিতেই বেঁচে থাকেন। তাঁদের বিমা বা অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা নেই বললেই চলে। সর্বজনীন ন্যূনতম আয় এ সব দেশে অন্তত খানিকটা মৌলিক নিরাপত্তা দিতে পারবে। আর্থিক সঙ্কটের সময়েও কিছুটা সুরক্ষা মিলবে।

অর্থনীতি বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in

অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy