গৌতম মণ্ডল। ফাইল চিত্র
জেল হেফাজতে এক প্রতিবন্ধী যুবকের মৃত্যুর প্রতিবাদে দেগঙ্গায় জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ ঘটিয়া গেল। জনজীবনে এমন বিশৃঙ্খলা সমর্থনের যোগ্য নহে। কিন্তু ক্ষুব্ধ মানুষগুলির ক্ষোভ মাপিবে কে? অসামান্য অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া যে সামান্য হইবে না, সেই সত্যটি না মানিয়া উপায় নাই। কী ভাবে ওই প্রতিবন্ধী যুবক সরকারি হেফাজতে প্রাণ হারাইলেন, কেন তাঁহার মর্মান্তিক মৃত্যুর পরেও তাঁহার পরিবারকে পুলিশ ক্রমাগত হয়রান ও অপমান করিল, তাহার গুরুত্ব বুঝাইতে চাহিলে বোধ করি নূতন ভাষার প্রয়োজন। পরিচিত বর্ণমালা, প্রচলিত শব্দভাণ্ডার হইতে তাহার উপযুক্ত উপকরণ আহরণ করা অসম্ভব। সংবাদে প্রকাশ, প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দুর্যোগের সম্ভাবনা অগ্রাহ্য করিয়া গৌতম মণ্ডল কাজে বাহির হইয়াছিলেন। অতঃপর বারাসত স্টেশনে ট্রেনে ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে রেল পুলিশ তাঁহাকে গ্রেফতার করে। চার দিন পরে দমদম সেন্ট্রাল জেলে তাঁহার মৃত্যু হয়। পরিবারের অভিযোগ, রেল পুলিশ তাঁহার উপরে নির্বিচার প্রহার করিয়াছে, অনাহারে রাখিয়াছে, এবং কারা দফতরে বন্দির চিকিৎসার প্রয়োজনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় নাই। বিষয়টি তদন্তাধীন। তবে পুলিশ এবং কারা দফতরের আধিকারিকদের কর্মপদ্ধতির সহিত যাঁহাদের কিঞ্চিৎ পরিচয় রহিয়াছে, তাঁহারা এই সকল অভিযোগে বিশেষ বিস্মিত হইবেন না। বিচারাধীন বন্দির অধিকার যে আইনের বইয়ে আবদ্ধ থাকিবে, বাস্তবের সহিত তাহার সম্পর্ক থাকিবে না, ইহাই এ দেশে প্রত্যাশিত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক গত বৎসর রাজ্যসভায় জেল হেফাজতে মৃত্যু সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট পেশ করিয়াছিল। তাহাতে প্রকাশ, গড়ে প্রতি দিন পাঁচটি মৃত্যু ঘটিয়া থাকে জেল হেফাজতে। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যাও কম নহে। আইন কমিশন সুপারিশ করিয়াছে, হেফাজতে লইবার পর বন্দির উপর যে নির্যাতন করিবে, পুলিশবাহিনী, আধা-সামরিক বা সামরিক বাহিনীর সেই আধিকারিকের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তদন্ত যথেষ্ট নহে, ফৌজদারি ধারায় তাহার বিচার করিতে হইবে। বলা বাহুল্য, সেই সুপারিশ গৃহীত হয় নাই। কিন্তু প্রশ্নটি কেবল আইনের নহে, দোষীর বিচারও একমাত্র বিবেচনা নহে। প্রশ্নটি নাগরিকের প্রতি আইনরক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গির। পুলিশ এবং কারাকর্তাদের প্রতি নিহত গৌতমের পরিবার ও প্রতিবেশী যে বিক্ষুব্ধ হইয়াছেন, তাহার অন্যতম কারণ মৃতের পরিবারের প্রতি অপমান। মরদেহ পরিবারের হাতে তুলিয়া দিবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিতে যে চূড়ান্ত দীর্ঘসূত্রতা এবং অপেশাদারিত্ব দেখা গিয়াছে, টালা থানা, দেগঙ্গা থানা, বারাসত রেল পুলিশ এবং দমদম সেন্ট্রাল জেলের কর্তৃপক্ষ যে ভাবে পর্যায়ক্রমে শোকার্ত আত্মীয়স্বজনকে ঘুরাইয়াছে, এবং অবশেষে দেহ না দিয়া ফিরাইয়া দিয়াছে, তাহাতে অতি ধৈর্যশীল মানুষেরও তীব্র ক্রোধ জন্মাইতে বাধ্য।
ইহাই কি নাগরিকের প্রতি সরকারের কর্তব্য? ইহাই আর্তের প্রতি প্রশাসনের সহমর্মিতা? দায়বদ্ধতা, পেশাদারিত্ব প্রভৃতি শব্দগুলি কি অন্তর্হিত? রেল পুলিশ, থানার পুলিশ ও কারাকর্তাদের আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াও একটি কথা বলিতে হয়। শুধু সরকারি আধিকারিককে দুষিলেই কি কাজ হইবে? সংশয় হয়, পুলিশি নির্যাতন সম্পর্কে সমাজের আপত্তিও যথেষ্ট প্রবল নহে। তাহার ফল ভোগ করিতে হয় গৌতম মণ্ডলের মতো দরিদ্র মানুষকে। তাঁহাদের বাঁচিবার অধিকার, বিচার পাইবার অধিকারকে রাষ্ট্র এত সহজে অস্বীকার করিতে পারে, কারণ নাগরিক সমাজও তাহাকে মান্যতা দিতে নারাজ। উত্তেজিত জনতার নিয়ন্ত্রণ অথবা ‘কথা বাহির’ করিবার প্রয়োজন, কোনও কারণেই পুলিশের নির্যাতন সমর্থনযোগ্য নহে— এই মৌলিক সত্যটি নাগরিক সমাজ স্বীকার না করিলে অসহায় বার বার মরিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy