ছবি: এএফপি।
কয়েক মাস পার হইয়াছে, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন এখনও শিরোনামে। অতিমারির আবহে তাহার প্রকাশ্য রূপ খানিক নমিত, কিন্তু প্রভাব এখনও অনুভূত। আমেরিকার গণ্ডি ছাড়াইয়া তাহা হইয়া উঠিয়াছে এক বৈশ্বিক আন্দোলন, এই সময়ের এক অবিসংবাদিত অভিজ্ঞান। কয়েক শতক ধরে চলিয়া আসা কৃষ্ণাঙ্গ পীড়ন ও শোষণ যাহাতে বন্ধ হয়, শ্বেতাঙ্গ বা অন্য যে কোনও নাগরিকের মতো কৃষ্ণাঙ্গরাও যাহাতে সামাজিক ন্যায়, আর্থিক নিরাপত্তা-সহ সমানাধিকার পান, সেই লক্ষ্যে প্রয়াস অতীতে কম হয় নাই। রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে যে একমাত্র জর্জ ফ্লয়েডই নিহত হইয়াছেন তাহাও নহে, তালিকা সুদীর্ঘ। তৎসত্ত্বেও কৃষ্ণাঙ্গ এই যুবকের মৃত্যু যে আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশের ছোটবড় শহরবাসীকে রাজপথে নামাইল, এক সূত্রে গাঁথিল, তাহা হইতেই তাহার তীব্র অভিঘাত পরিস্ফুট।
আন্দোলনের সমর্থন বিপুল, আবার অন্য কথাও উঠিয়াছে। কৃষ্ণাঙ্গরা অদ্যাবধি শোষিত, এই নিদারুণ সত্য স্বীকার করিয়াও উদ্বেগ প্রকাশ করা হইয়াছে, গণআন্দোলনের অন্তরালে ইহা সেই কৃষ্ণাঙ্গ বনাম শ্বেতাঙ্গের লড়াইকেই পায়ের তলার মাটি জোগাইতেছে না তো? প্রদীপের নীচেই অন্ধকারের মতো, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার আন্দোলনের অগোচরে ইহা কি বর্ণবিবাদ বা ‘রেস ওয়র’কে ইন্ধন দিতেছে? তাহা অপেক্ষাও বড় প্রশ্ন, অতীতের বহু বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের মতোই ইহা পরে নিঃশেষ হইয়া যাইবে না তো? এখন যাহা দাউদাউ অগ্নিশিখা বলিয়া বোধ হইতেছে, ভবিষ্যৎ তাহাকে কেবল সম্ভাবনাময় এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বলিয়া চিহ্নিত করিবে না তো? গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে কেবল তাৎক্ষণিক ভাবে প্রবল হইলেই চলে না, ধারাবাহিকতা দেখাইতে হয়। ঘটনাবিশেষের পরিণামে বহু মানুষের ঘনীভূত বিক্ষোভ আন্দোলনে পরিণত হইলে তাৎক্ষণিক উত্তেজনাতেও অগণিত মানুষ তাহা সমর্থন করেন। কিন্তু গণআন্দোলনের আসল পরীক্ষা তাহার টিকিয়া থাকিবার জোরে, ভবিষ্যতে তাহা সমাজমনে প্রভাব বিস্তার করিতেছে কি না বা কতখানি করিতেছে, তাহার উপরে। আমেরিকার সুবিধা, এই দেশ পূর্বে মার্টিন লুথার কিং-এর নাগরিক অধিকার আন্দোলন দেখিয়াছে। অদূর অতীতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হইয়াছিলেন বারাক ওবামা, প্রশাসনিক শীর্ষপদে এক কৃষ্ণাঙ্গের আসীন হইবার যাত্রায় পাশে দাঁড়াইয়াছিল সংবিধান, আইন ও সর্বোপরি নির্বাচনী জনমত। এই উদাহরণগুলি আছে বলিয়াই এই মুহূর্তের আন্দোলন লইয়া আশা জাগে, নাগরিকের শুভবোধ বৃথা যাইবে না।
শুধু নাগরিক সদিচ্ছাই যথেষ্ট নহে। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রক্ষায় নাগরিকের সক্রিয় তৎপরতাও জরুরি। যে সক্রিয়তা নজর রাখে, সহনাগরিকও সমান আর্থিক ও সামাজিক ন্যায় পাইতেছেন কি না, অন্য বর্ণের বা জাতির বলিয়া তাঁহার উপর বিভেদ বিদ্বেষ নামিয়া আসিতেছে কি না, পুলিশ বা সমাজ হাঁটু দিয়া চাপিয়া তাঁহার শ্বাসরোধ করিতেছে না তো? সংখ্যাগুরুর জনমত অনেক সময়েই শৃঙ্খলা বা স্থিতাবস্থা চাহিতে গিয়া সুবিচারকে ভুলিয়া বসে। ভিন্ন রঙের, জাতির, সামাজিক অবস্থানের মানুষ তখন কেবলই অবিচারের শিকার হইতে থাকেন। আমেরিকাকে ইহা দেখিতে হইবে। সাত সমুদ্র পারের ভারতও দেখুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy