প্রতি বছর শীতে দুটি বিষয় ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে। আলু-চাষিদের দুর্দশা, এমনকী আত্মহত্যা। আর আলুর দামে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা হ্রাস। অর্থনীতির সূত্র মেনে ধরে নেওয়া হয়, ফলন বাড়লে দাম কমে, ফলন কমলে দাম বাড়ে। কিন্তু আসলে দামের ওঠাপড়ার সঙ্গে ফলনের খুব একটা সম্পর্ক নেই। ফলন কম হলেও ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন চাষি।
সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, আলু চাষে লাভ এমন কিছু বিষয়ের উপরে নির্ভরশীল, যা চাষির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সামাজিক ও আর্থ-রাজনৈতিক সম্পর্কের বিন্যাস চাষির লাভকে নিয়ন্ত্রণ করে। খেত থেকে আলু তোলার পরে চাষিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, উৎপন্ন ফসল সরাসরি বাজারে বিক্রি করবেন না হিমঘরে রাখবেন? কোন বাজারে ভাল দাম মিলবে? হিমঘরে আলু রাখার জায়গা আছে তো? প্রতিটি প্রশ্ন জরুরি, কারণ পরিবহণ-সংরক্ষণের খরচ অনেক।
কিন্তু উত্তর পাওয়ার উপায় নেই চাষির। এ সব তথ্য হিমঘর মালিক, বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং ফড়েদের কাছেই কেবল থাকে। প্রান্তিক চাষি ঝুঁকি নিয়ে হিমঘরে রাখতে চাইলেও পারেন না। তাঁকে শুনতে হয়, ‘স্টোরে জায়গা নেই, আপনি অমুকবাবুর কাছে যান।’ অমুকবাবুরা আলু বাজারে বিক্রি করছেন না হিমঘরে রাখছেন, তা অজানাই থাকে চাষির।
এর সঙ্গে যোগ হয় আলুর বন্ডের হাতবদল। প্রতি বার বন্ড কেনাবেচায় যুক্ত থাকে লাভক্ষতির হিসাব। আর প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করেন হিমঘর মালিক তথা স্থানীয় প্রভাবশালীরা। একটি অদেখা ‘নেটওয়ার্ক’ এখানে খুব শক্তিশালী। তার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগী, রাজনৈতিক নেতা এবং ধনী ব্যবসায়ী। মরসুমের শুরু থেকে আলুর নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ এই নেটওয়ার্কের হাতে পৌঁছোয়। ফলে বাজারে আলুর বণ্টন, তথা দামেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে এই নেটওয়ার্ক। ছোট চাষির পক্ষে এর বাইরে গিয়ে আলুর বিক্রি বা সংরক্ষণ প্রায় অসম্ভব।
আলু চাষে ক্ষতির কারণে আত্মহত্যা করেছেন, এমন কয়েক জন চাষির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, প্রতি ক্ষেত্রেই এঁরা চড়া দরে মহাজনের থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এই মহাজনরা প্রত্যেকেই আলু ও হিমঘরের (‘রাখি মাল’-এর) ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তৃণমূলের শাসনকালে কৃষি-বরাদ্দ প্রায় ছ’গুণ বেড়েছে, বর্তমানে রাজ্যে প্রায় ৩৯০টি হিমঘর আছে। অথচ চাষির নেটওয়ার্ক-নির্ভরতা দূর করা যায়নি।
তবু আলুর চাষ হয় তিনটি কারণে। এক, দাম ওঠানামা সত্ত্বেও আলু চাষ প্রায়ই লাভজনক হয়। দুই, আলু তুলনায় কম পচনশীল। তিন, আলু চাষে মহাজনের থেকে দ্রুত ঋণ ও বিপণনে সাহায্য মেলে। যতই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করুক, স্বল্পমেয়াদে এই নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা চাষির পক্ষে সুবিধাজনক।
তবে কি এর পরিবর্তন সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। এ রাজ্যেই গত দু’বছরে সরকারের কয়েকটি উদ্যোগ কাজ দিয়েছে। যেমন ভিন রাজ্যে আলু রফতানিতে উৎসাহ দিতে পরিবহণে ভর্তুকি। ২০১৬-১৭ সালে আলু উৎপাদন প্রায় বাইশ শতাংশ বাড়ে। সড়ক ও রেলে ভর্তুকি দেওয়ায় আলুর বাজারদর তেমন পড়েনি। চাষিরা সামান্য দামে বিক্রির হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। অন্য রাজ্যের দরজা খুলে যাওয়ায় ব্যবসায়ী-নেটওয়ার্কের সর্বময় কর্তৃত্বও ধাক্কা খেয়েছিল। সম্ভবত এই সাফল্য থেকে শিক্ষা নিয়েই ২০১৭-১৮ সালে সরকার হিমঘর চালু রাখে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, আগের বছরের চাইতে তেইশ দিন বেশি; এবং কুইন্টাল প্রতি ৫০ টাকা ও ১০০ টাকা সড়ক ও রেলপথে ভর্তুকি দেওয়া হয় ১৫ জানুয়ারি অবধি। আলুবন্ড নিয়ে ‘নেটওয়ার্ক’-এর ছত্রছায়ায় হাতবদল ও ফাটকাবাজিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে সরকার।
তার ফলও মিলেছে। চলতি মরসুমে রাজ্যের খুচরো বাজারে আলুর দাম প্রায় কোথাও কুড়ি-পঁচিশ টাকা কিলোগ্রাম ছাড়ায়নি। অভাবী বিক্রিও রোখা গিয়েছে। যে সব চাষি ডিসেম্বর পর্যন্ত আলু বিক্রি করতে পারেননি, তাঁরা অন্য বছরের মতো নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হননি। আলুচাষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কোনও চাষি আত্মহত্যা করেছেন, এমন খবর এখনও পর্যন্ত মেলেনি।
এ বার শীতের গোড়ায় বৃষ্টিতে আলু চাষ পিছিয়ে যায়। জানুয়ারির শুরুতে তাই কোথাও কোথাও আলুর খুচরো মূল্য বাড়ে। মফস্সলে কিছু এলাকায় ৩১ ডিসেম্বরের পর পুরনো আলু সামান্য দামে বিক্রিও হয়েছে। তবে এগুলি বিচ্ছিন্ন ছবি, পরে তেমন চোখে পড়েনি। চাষি আর হিমঘর-নির্ভর নন, স্থানীয় বাজার-নির্ভরও নন— অন্য রাজ্যে তাঁর ফসলের চাহিদা থাকায় এখানে দাম পেয়েছেন।
তবে মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট থেকে চাষি এখনও মুক্ত নন। সমবায় না থাকায় পরিবহণে ভর্তুকি-সহ নানা সরকারি সুবিধে চাষির হাতছাড়া হচ্ছে। পরিবহণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাসে অনেকে বেশ কিছু অনৈতিক উপার্জন করেছেন। তবু সরকারের এই উদ্যোগ মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে একটি পদক্ষেপ। কৃষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থার সংস্কারে ধারাবাহিকতা রাখা গেলে চাষির রোজগার বাড়তে পারে, সে ইঙ্গিত মিলছে।
ড. এ পি জে আব্দুল কালাম গভর্নমেন্ট কলেজে নৃতত্ত্বের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy