ত্রিপুরার ঘাঁটির পতনের পর দল যখন হীনমান, এপ্রিলে হায়দরাবাদের পার্টি কংগ্রেসে আরও এক দফা পাত্রাধার তৈল ও তৈলাধার পাত্রের কূট তর্ক করিবার প্রস্তুতি চলিতেছে, তখন মহারাষ্ট্রের সড়ক পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়ার লালে ঢাকিয়া গেল। নাশিক হইতে মুম্বইয়ের দশ দিনব্যাপী মিছিলে মানুষ ক্রমে বাড়িয়াছে। তাঁহাদের হাতের পতাকা, মাথার টুপিতে বসন্তের ফুল বলিয়া বিভ্রম হইতেই পারে। কিন্তু, দেবেন্দ্র ফডণবীসরা জানেন, ইহা বজ্রনির্ঘোষ। বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ। কৃষকদের মিছিল বিধানসভায় পৌঁছাইবার পূর্বেই মহারাষ্ট্র সরকার সিদ্ধান্ত করিয়া ফেলিল যে কৃষকদের সব দাবিই মানিয়া লওয়া হইবে। বহু প্রশ্ন আছে। কৃষিঋণ মকুব করিলেই কৃষকের উপকার হয় কি না; গত বৎসর যে ঋণ মকুব হইয়াছিল, তাহার ফল আদৌ কৃষকদের নিকট পৌঁছাইয়াছিল কি না; সরকার ফের শর্ত আরোপ করিবে কি না— কৃষকদের দাবি মানিবার ঘোষণাতে এই প্রশ্নগুলির কোনওটিরই সুনির্দিষ্ট জবাব মিলে নাই। মহারাষ্ট্রের কৃষিতে সমস্যা কতখানি গভীর, কৃষকদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানেই তাহার প্রমাণ। এই মিছিল, এবং তাহার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে সেই সমস্যা মিটিয়া যাইবে, এমন আশা কাহারও নাই। তবুও এই মুহূর্তটি জরুরি। একাধিক কারণে। গৌণ কারণটি হইল, মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রকৃত প্রস্তাবে একটি স্বীকারোক্তি— কেন্দ্রে বিজেপির চার বৎসরের শাসন যে কৃষকদের জন্য ‘অচ্ছে দিন’-এর লেশমাত্রও আনিয়া দিতে পারে নাই, তাহার স্বীকারোক্তি।
আর, মুখ্য কারণ, এই মিছিল দেখাইয়া দিল, ভারতে এখনও বহুজনের দাবিদাওয়াকে কেন্দ্র করিয়া বৃহৎ পরিসরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলন সম্ভব। দশ দিনের মিছিলে হিংসা ছিল না, ধর্ম-জাতপাতও ছিল না। ছিলেন বিপুলসংখ্যক খাটিয়া খাওয়া মানুষ, জমি ছাড়িয়া মিছিলে যোগ দিতে হইলে যাঁহাদের দৈনিক রোজগারটি ছাড়িয়া আসিতে হয়। রাজনীতির উত্তেজনায় তাঁহারা কাণ্ডজ্ঞান হারান নাই— মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষার্থীদের যাহাতে সমস্যা না হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে তাঁহারা মিছিলের শেষ পথটুকু রাত থাকিতেই পার হইয়া গিয়াছেন। সচেতন সিদ্ধান্ত, এবং অতি অবশ্যই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। গ্রামের কৃষকের সহিত শহুরে মধ্যবিত্তের যে বিরোধ নাই, এবং একের প্রতিবাদে অন্যেরও স্থান রহিয়াছে, না বলিয়াই এই কথাটি তাঁহারা বলিয়া দিলেন। ফলও মিলিল। বাণিজ্যনগরীর মানুষ কৃষকদের পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহাদের দাবিতে গলা মিলাইয়াছেন। গণতন্ত্রের পরিসর যে শুধুমাত্র ব্যক্তি-পরিচিতির ঘেরাটোপে সীমিত নহে, বৃহত্তর জোট সম্ভব— তাহা দেখাইয়া দেওয়ার জন্যই এই মুহূর্তটি জরুরি। মানুষের প্রকৃত সমস্যাকে রাজনীতির প্রশ্ন করিয়া তুলিতে পারিলে যে আন্দোলন গড়িয়া তোলা যায়, দ্ব্যর্থহীন ভাবে এই কথাটি উচ্চারণ করিবার জন্যও মুহূর্তটি গুরুত্বপূর্ণ।
সীতারাম ইয়েচুরি মুম্বই গিয়াছিলেন। প্রকাশ কারাটও নিশ্চয়ই খোঁজখবর রাখিয়াছেন। কিন্তু তাঁহারা শিখিলেন কি? বামপন্থী রাজনীতির প্রধানতম কাজ সাধারণ মানুষের দাবিগুলিকে রাজনীতির মূলস্রোতে লইয়া আসা, তাহার জন্য লড়াই করা, এবং সেই দাবিগুলিকে যাহাতে জাতপাত বা ধর্মের রাজনীতি আসিয়া লইয়া না যাইতে পারে, তাহা নিশ্চিত করা। এ কে গোপালন ভবনের কর্তাদের কি এই কথাগুলি আদৌ স্মরণে আছে? ২০১১ সালে পরাজয়ের পর পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদের দল এমন ভাবে গুটাইয়া গিয়াছে যে সন্দেহ হয়, সরকার চালানো ব্যতিরেকে অন্য কোনও কাজের পদ্ধতি তাঁহারা ভুলিয়াছেন। ত্রিপুরার হারের পর সেই হাওয়া আরও জোরে বহিতেছে। রাজনীতি যে শুধু শাসনের নহে, মূলত সংগঠনের, মহারাষ্ট্রের মিছিল হইতে এই কথাটি তাঁহারা শিখিবেন, এমন সম্ভাবনা দূর অস্ত্।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy