১৯৯৮ সাল। কলকাতা হাইকোর্ট সদ্য রায় দিয়েছে, রাজ্যে নব্বই ডেসিবেলের ওপর শব্দবাজি ফাটানো নিষিদ্ধ, প্রধানত রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুলিশের উপর দায়িত্ব পড়েছে সে রায় কার্যকর করার। কালীপুজো ও দেওয়ালির রাতে দেখা গেল নব্বই দূরস্থান, প্রায় কোনও বাজিই রাস্তায় ফাটছে না। যেটুকু এ ধার ও ধার ফাটছে, সেগুলি সামলাতে পুলিশ ও পর্ষদের আধিকারিকরা চতুর্দিকে দৌড়চ্ছেন; কখনও বস্তির গলি ধরে, কখনও বা বহুতলের ছাদে! এক কথায়, প্রশাসন আদালতের নির্দেশ বলবৎ করার চেষ্টা করেছিল, ফলত সেই নিষেধাজ্ঞার কাছে শব্দবাজি হেরে ভূত হয়েছিল।
২০১৮ সাল। স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি রায় দিয়েছে যে বাজির নির্ধারিত শব্দমাত্রা তো মানতেই হবে, বৈধ বাজিও ফাটাতে হবে রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে। এবং, রায় কার্যকর করতে গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ-প্রধানের উপর আদালত অবমাননার দায় বর্তাতে পারে। কালীপুজো, দেওয়ালি ও বিসর্জনের রাতে দেখা গেল, প্রচণ্ড শব্দে বাজি ফাটল মাঝ রাত ছাড়িয়ে, সঙ্গে কান ফাটানো ‘ডিজে’ ও মাইক। পরে সরকারি তথ্যেও আইন ভাঙার কথা কার্যত স্বীকৃত হয়েছে। অথচ পুলিশ অন্য দিকে তাকিয়ে রইল, কিংবা কিছু মামলা ঠুকে নিয়মরক্ষা করল। অর্থাৎ দু’দশকের পুরনো ফল স্রেফ উল্টে গেল ২০১৮’য়। আদালতের রায় হেরে গেল শব্দবাজির তাণ্ডবের কাছে।
কেন দু’দশকের তফাতে এমন উলটপুরাণ? ১৯৯৮’তে যা ছিল নিয়ম মানার চেষ্টা, ২০১৮’তে তা স্রেফ নিয়মরক্ষার খেলা হয়ে দাঁড়াল কেন?
কাউকেই ‘জোর করে শব্দ শোনানো যায় না’, এ কথা বলে ১৯৯৮ সালে যখন অধুনা-প্রয়াত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বাজি-সহ নানা ধরনের শব্দ দূষণের উৎসের উপর নিয়ন্ত্রণ এনেছিলেন, বিরোধিতা কম হয়নি। ক্ষমতাসীন সিপিএম-এর নানা নেতা প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে বাজি-ব্যবসায়ীদের মদত দেন। কিন্তু রাজ্যের প্রশাসন, বিশেষত দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুলিশ, রাজনীতিকদের বিরোধিতা সত্ত্বেও, আদালতের রায়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উদ্যোগ করেছিল। তার ফলেই একুশ শতকের গোড়ায় দেখা গেল, এ রাজ্য দেশের মধ্যে শব্দ নিয়ন্ত্রণে মডেল হয়ে উঠেছে। এই রাজ্যে বাজির আওয়াজের উপর জারি থাকা নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে বহু মামলা হলেও তা খারিজ হয়ে যায়। যাঁরা দাবি করছিলেন যে বাজির উপর হস্তক্ষেপের মানে হল সাধারণ মানুষের ইচ্ছার ওপর হস্তক্ষেপ, তাঁদের পিছু হটতে হল, যখন এক সমীক্ষা জানাল যে নব্বই শতাংশের ওপর মানুষ এমন কান ফাটানো শব্দবাজি চান না।
২০১৮ সালেও অনেকে বলছেন, মানুষ সচেতন না হলে বাজির সমস্যা মিটবে না। আরও সচেতনতা নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু এটাও ঠিক যে, কার্যত সেই প্রাক-ইন্টারনেট, প্রাক-মোবাইল যুগের তুলনায় পরিবেশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতা এখন অনেকটাই বেড়েছে। তা হলে? আসলে উত্তরটা লুকিয়ে আছে প্রশাসনিক সদিচ্ছার বাস্তবে। চিরকালই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশ সশব্দে আইন ভাঙে, আর বাকি বৃহত্তর অংশ নিঃশব্দে তা সহ্য করে। মনে রাখতে হবে এই নিয়ম ভাঙার দলে উঁচুনিচু প্রভেদ নেই; বস্তিও আছে, বহুতলও আছে। এই লড়াইটা কঠিন হয়ে পড়ে যখন প্রশাসনের একাংশ অপরাধীদের সামনে শিরদাঁড়া নোয়াতে শুরু করে; কখনও রাজনৈতিক চাপে, কখনও অন্য সুবিধা খুঁজে পেতে। সেই প্রবণতা গত দু’দশকে বিপুল বেড়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে আগে অত্যন্ত সদর্থক ভূমিকা নেওয়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে শুরু করে পুলিশ অবধি। শিরদাঁড়াযুক্ত পুলিশ এখন প্রায় ডোডো পাখির মতোই বিপন্ন। ব্যতিক্রমী আছেন, কিন্তু শব্দ-লুম্পেনদের হাতে তাঁদের মার খাওয়ার খবর কাগজে ছাপা হয়। সংশয় হয়, শব্দ আইন ভাঙার ও সেই অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য কি এক মহাজোট তৈরি হয়েছে প্রশাসনের, বিশেষ করে পুলিশের একটা অংশের সঙ্গে আইনভঙ্গকারীদের ও তাদের প্রশ্রয়দাতা ক্ষমতাবান স্থানীয় নেতানেত্রীদের যোগসাজশে? যার ফলে বিসর্জনের সময় চোখের সামনে প্রচণ্ড শব্দে চকলেট বোম ফাটলেও কানে হাত চেপে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেন উর্দিধারীরা; কেউ শব্দবাজির প্রতিবাদ করলে অপরাধীর শাস্তি তো হয়ই না; শেষ পর্যন্ত হয়তো অভিযোগকারীকেই পিছিয়ে আসতে হয়। মনে পড়ে, প্রয়াত বিচারপতি ভগবতীবাবুকে এক বার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রাজ্যে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’-এর কী অবস্থা। স্বভাবরসিক ভগবতীবাবু চটজলদি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ল আছে, অর্ডার নেই।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy