Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
Editorial News

ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর ১৯১১

১৯১১ শুনলে আপনার সবার আগে মনে পড়বে, ওই বছরই বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল। সেই সঙ্গে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আপনি বলবেন, ওই বছর থেকেই বাঙালি আধিপত্যের শেষের শুরু।আপনার বয়স যদি সত্তর বা তার বেশি হয়, তাহলে ১৯১১ শুনলে আপনার সবার আগে মনে পড়বে, ওই বছরই বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল... লিখছেন আশীষ লাহিড়ী

শুধু ফুটবল তো নয়, সুখে-দুঃখে ১৯১১ মিশে আছে আমাদের ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

শুধু ফুটবল তো নয়, সুখে-দুঃখে ১৯১১ মিশে আছে আমাদের ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

আশীষ লাহিড়ী
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৯ ২২:৩৫
Share: Save:

১৯১১ সালের কথাশোনা মাত্র ফুটবল-পাগল বাঙালি বলবে, ওই বছরই খালি-পদ মোহনবাগান ক্লাব বুট-পরা ব্রিটিশ সৈন্যদের ইস্ট ইয়র্কশায়ার দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জেতে। ঘটি-বাঙাল নির্বিশেষে ফুটবল খেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির এই একাদশী জাতীয়তাবাদী আবেগ। ফড়িয়াপুকুরের শিবদাস ভাদুড়ি স্ট্রিট তার অম্লান সাক্ষ্য বহন করছে আজও। মতি নন্দী অবশ্য বেয়াড়া এক প্রশ্ন তুলেছিলেন: এত জাতীয়তাবাদী আবেগ সত্ত্বেও মোহনবাগানকে পরের বার শিল্ড জেতার জন্য ‘৩৬ বছর অপেক্ষা করতে’ হয়েছিল কেন!

কিন্তু শুধু ফুটবল তো নয়, সুখে-দুঃখে ১৯১১ মিশে আছে আমাদের ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিপ্লবী বীণা দাস, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আর দীনেশ গুপ্তরও জন্ম ওই সালেই। জগদীশচন্দ্র বসু আর অবলা বসুর সমস্ত শুশ্রূষা ও পরিচর্যাকে হার মানিয়ে ওই বছরই দার্জিলিঙে মৃত্যু হয়েছিল সিস্টার নিবেদিতার। আর ওই ১৯১১ সালেই শাপভ্রষ্ট এক গন্ধর্ব জন্ম নিয়েছিলেন মনুষ্যদেহ ধরে। তাঁর নাম দেবব্রত বিশ্বাস। ১৯১১ সালে পঞ্চম জর্জ ভারতে এসেছিলেন, সেই হুজুগে তাঁর ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল ‘জর্জ’। আজ পঞ্চম জর্জ মৃত; জর্জ বিশ্বাস চিরায়ুষ্মান, দিন দিন তাঁর আয়ু বাড়ছে।

তবে আপনার বয়স যদি সত্তর বা তার বেশি হয়, তাহলে ১৯১১ শুনলে আপনার সবার আগে মনে পড়বে, ওই বছরই বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল। আর সেই সঙ্গে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আপনি বলবেন, ওই বছর থেকেই বাঙালি আধিপত্যের শেষের শুরু। কেননা, ওই সাল থেকে কলকাতা আর ব্রিটিশ রাজের রাজধানী রইল না। সদ্য সিংহাসনারূঢ় সম্রাট পঞ্চম জর্জ আররানি মেরি এলেনদিল্লি দরবারে। এর আগেও বিশাল খরচ করে দু-দুবার জমকালো ‘দরবার’ বসেছিল— একবার ১৮৭৭-এ, অন্যবার ১৯০৩-এ। দু’বারই দিল্লি অকুস্থল, যদিও কলকাতা রাজধানী। আসলে কলকাতা তো একটা ফিরিঙ্গি বেনিয়া শহর, তারনেই বনেদি দরবারি পরম্পরা, যেটা আছে দিল্লির। তার ওপর ১৮৫৭-র যুদ্ধে প্রায় হেরে যেতে যেতে দিল্লিতেই তো ব্রিটিশরা বিদ্রোহীদের চূড়ান্তভাবে কচুকাটা করেছিল, তাই দিল্লি তাদের কাছে এক তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। ১৮৭৭-র দরবারের উপযুক্ত জাঁকজমকের জন্য দিল্লির আশপাশের একশোটি গ্রামের কৃষকদের উৎখাত করা হয়েছিল। এদিকে তখন পশ্চিম ভারত জুড়ে চলছে বীভৎস দুর্ভিক্ষ। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জনৈক অফিসার উর্দু না-জানায় পুরস্কারের জন্য অপেক্ষারত সৈন্যদের ‘সওয়ার’-এর বদলে ‘শুয়ার’ বলে ডেকে চমৎকার অসচেতন শ্লেষের জন্ম দিয়েছিলেন। এরই পরম্পরায় এল ১৯১১-র দিল্লি দরবার। আর সেই সঙ্গে কলকাতা হয়ে গেল ব্রিটিশ রাজের দুয়োরানি। নথি ঘাঁটলে দেখা যায়, এ নিয়ে প্রবল ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল দ্য স্টেট্‌সম্যান এবং তার প্রধান কারণ ছিল কলকাতার বাণিজ্যিক গুরুত্ব! স্বপ্নের মতো শোনায় আজ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তবে ‘সম্রাট’পঞ্চম জর্জেরভারতভ্রমণ নিয়েবাঙালিদের প্রতিক্রিয়া বেশ মিশ্র। স্বদেশি চেতনার অন্যতম মুখ, ডন সোসাইটি-খ্যাত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় খুশি হয়ে বলেছিলেন, জর্জ সাহেব যে এত কষ্ট করে দু-দু’বার ভারতে এলেন (একবার প্রিন্স অ্যালবার্ট রূপে ১৯০৫-এ, অন্যবার খোদ সম্রাট হিসেবে ১৯১১-য়), এ তাঁর মহানুভবতারই নিদর্শন। এর মূলে আছে ‘ভারতকে প্রকৃষ্টরূপে সেবা করবার আকাঙ্ক্ষা। ভারতের মহত্ত্ব আর রাজসিকতা তাঁর হৃদয় হরণ করেছে।’সম্রাটের ওই ‘যুগান্তকারী সফর’-এর পিছনে নাকি রাষ্ট্রনীতির কোনও তাগিদ ছিল না, ছিল শুধু ‘হৃদয়ের টান’, যদিও তার ফলে ‘রাষ্ট্রনীতিও প্রভূতভাবে উপকৃত হয়েছে।’অথচ তখন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন শেষ হয়েছে, জাতীয়তাবাদী চেতনার নাকি উদ্বোধন ঘটে গেছে। বিপ্লবমন্ত্রের উদ্‌গাতা অরবিন্দ যোগসাধনাকরতেচলে গেছেন পন্ডিচেরিতে। বিপিনচন্দ্রপাল ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলার কথা বলতে শুরু করেছেন।

আরও পড়ুন: বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব না বুঝিয়ে জনগণকে স্বামীজির সরল কথা সরল ভাবেই বোঝানো যেত

অবশ্য শুধু বাঙালি কেন, সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করতেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীও। ১৯১১-র কয়েক বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু বিদ্রোহের সময় আগ বাড়িয়ে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীকে সাহায্য করা সম্বন্ধে তাঁর অকপট কবুলতি: ‘জুলুদের ওপর আমার কোনো রাগ ছিল না; তারা কোনো ভারতীয়র এতটুকু ক্ষতি করেনি। ওদের অভ্যুত্থানকে আমি “বিদ্রোহ” বলে চিহ্নিত করতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু তখন আমার মতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিশ্বের মঙ্গলের জন্যই বিরাজ করছিল এবং নাটাল, যা কিনা সেই সাম্রাজ্যর অন্তর্গত, তার নাগরিক হিসেবে আমি বাধ্য হলাম বড়লাটকে চিঠি লিখে ভারতীয় অ্যাম্বুলেন্স বাহিনি গঠন করার প্রস্তাব দিতে। প্রস্তাবটা তৎক্ষণাৎ গৃহীত হল।’এটা তিনি করেছিলেন তাঁর সেই অতিবিখ্যাত অন্তরের বাণীর বাধ্যবাধকতায়।

১৯১১-র ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্যে বিষয়মাহাত্ম্যে রবীন্দ্রনাথের এই জনগণমনঅধিনায়ক-ই বোধহয় আজ সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক।

আবার, আর একটু বেশি ইতিহাসমনস্ক হলে আপনার মনে পড়বেই, ওই ১৯১১ সালেই‘জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে’ গানটি রচিত ও গীত হয়েছিল কংগ্রেসের অধিবেশনে; আর ওই গানটিই সরকারিভাবে ১৯৫০ সালে ব্রিটিশমুক্ত ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হল। ইতিহাসের এই ঠাট্টাটুকু লক্ষ্য করেছেন সুগত বসু: ‘১৯১১-য় ব্রিটিশরা কলকাতা থেকে রাজধানী তুলে নিয়ে গিয়েছিল দিল্লিতে। আমাদের ঔপনিবেশিক প্রভুরা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে ওই বছরই এই শহরে ধ্বনিত হয়েছিল এমন একটি গান যা পরে দিল্লিতে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে তার জায়গায় তেরঙা পতাকা ওড়াবার সময় ভারতের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। সে-গান কিন্তু গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে কলকাতা থেকে দিল্লি যায়নি। গিয়েছিল ‘পতন-অভ্যুদয়-পন্থা’ ধরে- তামাম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশ্বব্যাপী যাত্রাপথ অতিক্রম করে সে-গান অবশেষে প্রতিটি ভারতবাসীর হৃদয়কন্দরে স্থান করে নিয়েছিল।’তার আগেই অবশ্য সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে হামবুর্গে ১৯৪২-এর ১১ সেপ্টেম্বর একটি জার্মান অর্কেস্ট্রা দিনেন্দ্রনাথের করা স্বরলিপির ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথের ওই গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বাজায়। ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারিভারতের স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের এক বিরাট অনুষ্ঠানে, বার্লিন রেডিওর অর্কেস্ট্রা মহা ধুমধাম করে জনগণমন-র বহুবাদ্য-সমন্বিত রূপটি বাজিয়েছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে আজাদ হিন্দ রেডিওর সেই সম্প্রচার শুনে উদ্বেলিত হয়েছিল অনেক ভারতীয়। আজাদ হিন্দ ফৌজ গানটির একটি সংক্ষেপিত হিন্দি অনুবাদও গাইত।

আরও পড়ুন: গড়ে তুলি বাঙালির ‘জাতীয়’ বা ‘ন্যাশনাল’ ইতিহাস ও সংস্কারের উদ্যোগ

১৯১১-র ঘটনাবৈচিত্র্যের মধ্যে বিষয়মাহাত্ম্যে রবীন্দ্রনাথের এই জনগণমনঅধিনায়ক-ই বোধহয় আজ সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। এই কারণে প্রাসঙ্গিক যে, ইদানীং কালে বিভিন্ন মহল থেকে জনগণমন-কেঘিরে আবার নানা ধরনের বিতর্ক তোলা হচ্ছে, কোনওটা হিন্দুত্ববাদী বদ উদ্দেশ্য-প্রণোদিত, কোনওটা সত্যিকারের বিভ্রান্তি-প্রসূত, যার কোনওটাই নতুন নয়। যেমন বাবরি মসজিদ-খ্যাত কল্যাণ সিংহ বলেছেন, আসল গলদটা আছে ওই ‘অধিনায়ক’ কথাটায়। ১৯১১ সালে ভারতের অধিনায়ক স্পষ্টতই ‘আংরেজি শাসকরা।’তাঁর মতে, অধিনায়ক শব্দটাকে বদলে ফেলে বসানো উচিত ‘মঙ্গল’। ‘আংরেজি শাসন’ নিয়ে কল্যাণজিদের পূর্বসুরিদের যে খুব একটা মাথাব্যথা ছিল তা অবশ্য নয়। আংরেজি শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তা সাভারকরের প্রাথমিক বীরত্ব অচিরে পর্যবসিত হয়েছিল আন্দামান জেলে বসে একের পর এক মুচলেকা দিয়ে নিজের শর্তাধীন মুক্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করায়। কাজেই আজ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ‘আংরেজি শাসন’-পন্থী হওয়ার উদ্গার আর যাই হোক, অন্তত কল্যাণজিদের মুখে মানায় না। তাছাড়া কল্যাণজির প্রেসক্রিপশন মাফিক ‘জনগণমনমঙ্গল জয় হে’ কেমন দাঁড়ায় কবিতা বা গান হিসেবে? কী বলেন ছন্দতত্ত্ববিদরা? অবশ্য অত ভাবার কী দরকার? বাবরি-ধ্বংসের তত্ত্বাবধায়ক কল্যাণজি তো ক্ষমাঘেন্না করে জানিয়েই দিয়েছেন, এর পরেও বেচারি রবীন্দ্রনাথকে তিনি ‘খুবই শ্রদ্ধা’ করেন। কপাল করে জন্মেছিলেন বটে রবীন্দ্রনাথ!

কূটকৌশলে ধুরন্ধর, মননে বালখিল্য এইসব রাজনীতিবিদের কথা নাহয় ধর্তব্যের মধ্যে না-ই আনলাম (অবশ্য না আনলে মগজে বা অন্যত্র গজাল মেরে গোঁজানোর কায়দাকানুন এঁদের ভালই জানা আছে), কিন্তুসুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন সভাপতি,মার্কণ্ডেয় কাটজুর মতো শিক্ষিত, বিচক্ষণ, যুক্তিবাদী মানুষও যখন এই প্রশ্ন তোলেন, তখন সেটাকে অত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি?২০১৫ সালে কাটজু সাহেব ন’টি তোপ দেগেছেন জনগণমন-র বিরুদ্ধে। সময়ের সমাপতনটি লক্ষ্য করেছেন তিনি:১৯১১ সাল, ঠিক যেসময় জর্জ-মেরি দিল্লি দরবারে এসেছেন। তাঁর মতে, কবিতাটিতে মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসার কোনও চিহ্ন নেই! ‘অধিনায়ক’ কিংবা ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ বলতে যে সম্রাট জর্জের শাসনাধীন ব্রিটিশ ভারতের অধিনায়ককেই বোঝাচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। কলকাতায় কংগ্রেসের যে-অধিবেশনে গানটি গাওয়া হয়, সেখানে সম্রাট জর্জকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। ধন্যবাদ জানানো হয়েছিল ‘বঙ্গভঙ্গ’ রদ করার জন্য।তাছাড়া, তিনি বলছেন, ১৯৩৬ সালে পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথ কোথাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেননি যে গানটি পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি নয়।এইসব ‘অকাট্য’ তথ্যের ভিত্তিতে জজসাহেবের রায়, জনগণমন আসলে পঞ্চম জর্জেরই স্তুতি। তাঁরই চরণে নাকি ভারতবাসীর ‘মাথা নত’ রাখার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নির্বোধ ভারতবাসীকে তিনি ভর্ৎসনা করেছেন এমন একটি গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়ার জন্য।

এর কোনওটাই নতুন প্রশ্ন নয়। ১৯৩৭ সালে পুলিনবিহারী সেন রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গানটি কোন ‘উপলক্ষে’ রচিত। ‘দেশের কোনো কোনো মহলে যে দুর্বাক্যের উদ্ভব হয়েছে’ তারই তাড়নায় পুলিনবিহারীর এই প্রশ্ন, সেটা বুঝতে কবির অসুবিধা হয়নি। তিনি লেখেন, ১৯১১-য় ‘ভারতসম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জনগণমনঅধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়ঘোষণা করেছি, পতনঅভ্যুদয়বন্ধুর পন্থায় যুগযুগধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচালক – সেই যুগ যুগান্তরের মানবভাগ্য রথচালক...পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জ্‌ই কোনোক্রমেই হতে পারেন না...।’এরও বছর দেড়েক পরে সুধারানী বসুকে তিনি লেখেন, ‘শাশ্বত মানব-ইতিহাসের যুগযুগধাবিত পথিকদের পথযাত্রায় চিরসারথি ব’লে আমি চতুর্থ বা পঞ্চম জর্জের স্তব করতে পারি, এরকম অপরিমিত মূঢ়তা আমার সম্বন্ধে যাঁরা সন্দেহ করেন তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আত্মাবমাননা।’অত্যন্ত প্রাঞ্জল বক্তব্য।

রবীন্দ্রনাথ যে-‘দুর্বাক্য’র কথা বলেছেন, তার মূলে ছিল কয়েকটি ব্রিটিশপন্থী খবরের কাগজের অলস কিংবা মতলববাজ সাংবাদিকতা। কলকাতা কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে ২৭ ডিসেম্বর ১৯১১ রবীন্দ্রনাথ তাঁর জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে গানটি গেয়ে শোনান। পরদিন স্টেট্‌সম্যান লিখল: ‘বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষভাবে সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে স্বরচিত একটি গান গেয়ে শোনান।’ ইংলিশম্যানও লেখে: ‘অনুষ্ঠানের শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে সম্রাটের সম্মানে স্বরচিত একটি গান গেয়ে শোনান।’

আরও পড়ুন: আমেরিকায় থেকেও আমি বাঙালিয়ানার মধ্যেই বাঁচি

অথচ আসল ঘটনা হল, ওই দিনপঞ্চম জর্জকে স্তুতি জানিয়ে রামভুজ চৌধুরী রচিত ‘হমারা বাদশা’ নামে একটি হিন্দি গান গাওয়া হয়েছিল, যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনও সম্পর্ক নেই। অমৃতবাজার, দ্য বেঙ্গলি প্রমুখ ভারতীয় সংবাদপত্রে ঘটনাটি ঠিকঠাক প্রতিবেদিত হয়েছিল।অমৃতবাজার স্পষ্ট করে জানায়, প্রথমে রবীন্দ্রনাথ ‘ঈশ্বরকে বন্দনা করে’ একটি গান করেন, তারপর সভায় সম্রাট-প্রশস্তির প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। অতঃপর সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে আর একটি গান পরিবেশিত হয়। দ্য বেঙ্গলি বাড়তি একটু তথ্য দিয়ে জানায়, এই অন্য গানটি গেয়েছিল ‘কয়েকটি ছেলেমেয়ের একটি দল।’ কংগ্রেসের নিজস্ব প্রতিবেদনে বিষয়টি আরও স্পষ্ট: ‘কংগ্রেসের আঠাশতম বার্ষিক অধিবেশনের প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় বন্দে মাতরম গান গেয়ে। দ্বিতীয় দিনের কাজ শুরু হয় বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীত একটি দেশাত্মবোধক গান দিয়ে। তারপর শুভানুধ্যায়ীদের বার্তাগুলি পাঠান্তেরাজা পঞ্চম জর্জের প্রতি আনুগত্যসূচক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অতঃপর রাজা জর্জ এবং রানি মেরিকে স্বাগত জানাবার জন্য রচিত একটি গান গাওয়া হয়।’

গানটির অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য মূলত রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকেই সমর্থন করে। সুগত বসু লক্ষ্য করেছেন, জনগণমনঅধিনায়ক নামক ‘এই ঐশ্বরিক সত্তা স্ত্রী না পুরুষ, তা অনিশ্চিত। ‘জনগণদুখত্রায়ক’ নারীরূপে আবির্ভূতা হন। “দুখস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে/স্নেহময়ী তুমি মাতা।” গানটিতে আশ্চর্যভাবে মিলে যায় ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্ব আর জনসম্পৃক্ত সার্বভৌমত্বর আবাহন। পিছন ফিরে দেখলে আজ মনে হয়, এ গানের জাতীয় সংগীত রূপে নির্বাচিত হওয়াটা ছিল অবধারিত।’সুতরাং অমৃতবাজার এবং দ্য বেঙ্গলি যে এ-গানটিকে যথাক্রমে ‘ঈশ্বরবন্দনা’ এবং ‘দেশাত্মবোধক’ বলে চিহ্নিত করেছিল, তাতে কোনও ভুল নেই, দুটোই সত্যি। রবীন্দ্রনাথ তো প্রচলিত অর্থে জাতীয়তাবাদী ছিলেন না, তবু ঘটনাচক্রে তাঁরই গান দু-দুটি দেশের জাতীয় সংগীত হয়ে গেল। ইতিহাসের গতি বড় বিচিত্র।

বৃহৎ এক বিশ্বজনীন মানবিকতায় পৌঁছনোর সে-মুক্তিপথে ইংরেজরা ত্যাজ্য নয়, স্বাগত:‘এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ।’

‘সন্দেহপিচাস’দের মন অবশ্য কুটিল। অস্বীকার করার জো নেই, রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার ধরনটা সেযুগের পক্ষে বড়ই ব্যতিক্রমী।তিনি মনে করতেন না যে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সশস্ত্র-নিরস্ত্র কোনও রকম রাজনৈতিক লড়াই করে মুক্তি আসবে। গাঁধীর অসহযোগ আর ক্ষুদিরামের বোমা, দুটোই তাঁর কাছে পরিত্যাজ্য। উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ আর সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্ত জাতীয়তাবাদ তাঁর চোখে সমান নিন্দনীয়। তাঁর মতে,প্রকৃত মুক্তি আসবে জাতীয়তাবাদের পথ ধরে নয়, স্বদেশি সমাজ গড়ে আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে উপেক্ষা করে নিজেদের উন্নতির পথ নিজেরা প্রশস্ত করে। অপর দিকে, পশ্চিম যে-দ্বার খুলে দিয়েছে সেখান থেকে সকলকে উপহার আনতে হবে ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ সম্পর্কটা ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’-র, আদা আর কাঁচকলার নয়। বৃহৎ এক বিশ্বজনীন মানবিকতায় পৌঁছনোর সে-মুক্তিপথে ইংরেজরা ত্যাজ্য নয়, স্বাগত:‘এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ।’ এই অবস্থানে তিনি আগাগোড়া অবিচল ছিলেন। এমনকি,১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড উপলক্ষে ‘ছার’ উপাধি ত্যাগ করে বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে লেখা তাঁর অবিস্মরণীয়প্রতিবাদপত্রটিতেও তিনি জানাতে ভোলেননি যে চেমসফোর্ডের ‘পূর্বসুরি’ লর্ড হার্ডিঞ্জের ‘হৃদয়ের মহত্ত্ব’র প্রতি তাঁর ‘উচ্চ প্রশংসার মনোভাব’ অটুট রয়েছে, যাঁর হাত থেকে তিনি ‘হিজ ম্যাজেস্টি দ্য কিং’, অর্থাৎ পঞ্চম জর্জের দেওয়া নাইটহুড পেয়ে সম্মানিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে ব্রিটিশকে তাড়ানো তাঁর অ্যাজেন্ডার মধ্যে পড়ে না; ব্রিটিশরা অন্যায় করলে তিনি গর্জে উঠবেন, আবার সে-অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ব্রিটিশদের বোমা মারলে তিনি সেটারও প্রতিবাদ করবেন। জীবনের বহু ‘ইনকনসিস্টেন্সি’র মধ্যে এই একটা জায়গায় তিনি বরাবর অবিচল।

এই পটভূমিতে ১৯৩৬-এ পঞ্চম জর্জের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে তিনি যে-তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন সেটা একবার স্মরণ করা যাক: ‘এত অকস্মাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপর যে শোকভার নিপতিত হইয়াছে, আমরা সকলেই তাহার অংশগ্রহণ করিতেছি। সম্রাট পঞ্চ মজর্জের এ ইপরলোকগমন ব্রিটিশ প্রজামণ্ডলীর নিকট কেবল একটা ক্ষতি নহে, তদপেক্ষাও অধিক। কেননা সমগ্র জগৎ আজ একজন প্রকৃত বিশ্ব শান্তিকামীকে হারাইল।’ আর মাত্র চার বছরের মধ্যে যাদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ‘সব বিশ্বাস দেউলে’ হয়ে যাবে, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শীর্ষব্যক্তিত্ব, যিনি নাকি ‘প্রকৃত বিশ্বশান্তিকামী’, তাঁর মৃত্যুতে ‘প্রজামণ্ডলীর’ এতটা শোক একটু যেন বিসদৃশ মনে হয়। নিছক রবীন্দ্রসুলভ সৌজন্য বলে একে অগ্রাহ্য করতে পারি কি? মার্কণ্ডেয় কাটজুর মতো রবীন্দ্র-নিন্দুকরা মনে করিয়ে দেন, ১৯১১-র জনগণমন গান নিয়ে এত বিরূপ সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু পঞ্চম জর্জের জীবৎকালে কখনও স্পষ্ট করে বলেননি যে ও-গান রাজস্তুতি নয়, হওয়া সম্ভব নয়।

সবশেষে একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলব। আজন্ম রবীন্দ্র-পরিবেশে স্নাত, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে ও গানে আপ্লুত, প্রয়াত গল্পকার ও প্রবন্ধকার সত্যপ্রিয় ঘোষ একদিন নানাকথার মধ্যে এই গানটির প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। ‘শাশ্বত মানব-ইতিহাসের যুগযুগধাবিত পথিকদের পথযাত্রায় চিরসারথি ব’লে...চতুর্থ বা পঞ্চম জর্জের স্তব’ করার মতো ‘অপরিমিত মূঢ়তা’ রবীন্দ্রনাথের ছিল না, অবশ্যই। কিন্তু মনের কোণে কোথাও ব্রিটিশ সভ্যতার ও শাসনের প্রতি একটা দুর্বলতা তাঁর ছিল, এই মত পোষণ করতেন সত্যপ্রিয় ঘোষ। তাঁর যুক্তি, অতিশয়োক্তি অলংকার কবিদের সহজাত কবচকুণ্ডল। কোনও একজন মহিমান্বিত ব্যক্তিত্বর ওপর দেবত্ব আরোপ করেতাঁরঅতিবন্দনা করাটা একজন কবির পক্ষে অসম্ভব নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে, জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে, উপনিবেশবাদ-বিরোধী আন্দোলন সম্বন্ধে, সশস্ত্র বৈপ্লবিক আন্দোলন সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর সৃষ্টিশীল কাব্যক্রিয়াকে অবচেতনে হয়তো কোথাও প্রভাবিত করেছিল, বিশেষ করে যেখানে তিনি অল্পকাল আগেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রত্যক্ষ উত্তেজনা থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নিয়েছিলেন। স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ আর রাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটা বিভেদরেখা কোথাও ছিল। জনগণমন গানের কোনওকোনওপঙ্‌ক্তির মধ্যে সেই দোলাচলের কিছু আভাস হয়তো পড়েছিল, এরকমই যেন বলেছিলেন সত্যপ্রিয় ঘোষ।

১৯১১-কে উপলক্ষ করে ইতিহাসের হৃদয় খুঁড়ে কিছু বেদনা জাগানোর উদ্দেশ্যে এই লেখা। আজ যখন হিন্দুত্ববাদী দাপটে ভারতের ভারতীয়ত্ব কবরস্থ হওয়ার উপক্রম, তখন ইতিহাস আমাদের একটা বড় ভরসা, সে-ইতিহাসের বেদনায় আমাদের মনের পেয়ালা ভরে উঠলে কিছু করার নেই।

(আশীষ লাহিড়ী প্রাবন্ধিক)

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE