কার্তিক পুজো শেষ হওয়ার বেশ কিছু দিন পরেও জলঙ্গী নদীর এমনই বেহাল দশা।
আমরা যখন ছোট, তখন সুতির জামাপ্যান্ট পড়তাম। এক বার কাচা হলেই সেগুলো একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে দলামোচা হয়ে যেত। আবার, পড়ার সময় সেগুলোকে হাত দিয়ে টেনে টেনে সোজা করে নিতাম। কারণ ইস্ত্রি করার মতো পয়সা বাবা-মার ছিল না। সে পোশাক পরতে সঙ্কোচবোধ হলেও কিছু করার ছিল না। এ শুধু আমার একার অবস্থা ছিল না, আমার মতো অসংখ্য দুঃস্থ বালক-বালিকার একই অবস্থা ছিল।
তখন বাবা-মা আশার বাণী শোনাতেন— ‘‘শুনেছি, এমন পোশাক আসছে যে কাচলেও আর কোঁচকাবে না। এর পরে তোদের সেই পোশাক কিনে দেব।’’
বললেই তো আর কিনে দেওয়া না। সে ছিল দামি পলেস্টার (পলি-এস্টার), টেরিলিন, টেরিকট। আমাদের সাধ্যের বাইরে। এর কিছু দিন পরেই আমাদের গ্রামের বাজারে এসে গেল বিদেশি সস্তার পলেস্টার, নাইলনের জামাপ্যান্ট। রিঙ্কল ফ্রি, পাকা রঙের লয়-ক্ষয়হীন পোশাক পেয়ে আমাদের হাতে তখন স্বর্গ। কেউ কেউ আড়চোখে তাকালেও আমরা ভ্রুক্ষেপ করতাম না। এখনকার মতো তখন প্যাশান-ফ্যাশান দূর অস্ত। শরীর আচ্ছাদনই ছিল মূল লক্ষ্য।
ভারতবর্ষে সেই ছিল প্লাস্টিকের সূচনা। নাইলন এক ধরনের প্লাস্টিক। এর পর একটু একটু করে সমস্ত দেশ, পরিবেশটাকেই গিলে ফেলল প্রকৃত প্লাস্টিক। মিষ্টির দোকানে চায়ের দোকানে মাটির হাড়ি, ভাঁড় অদৃশ্য হল। মুদি দোকানে কাপড়ের দোকানে কাগজের ঠোঙা, প্যাকেট বিলীন হল। গৃহকর্তার হাতে সুতো বা চটের থলির বদলে উঠল পলিথিনের ব্যাগ। শেষে দোকানদার প্রদত্ত ক্যারিব্যাগ। শুরু হল মাছ-মিষ্টি-তরকারি-মুদি-কাপড়-জুতো— সব দোকানেই ক্যারিব্যাগের অবাধ বিচরণ। গৃহস্থেরা খুশি। গৃহস্থের মতো মাছ-মিষ্টি-তরকারিরাও আহ্লাদে আটখানা। আহা! এত দিন এক দমবন্ধ করা অন্ধকার পরিবেশে দোকান থেকে হেঁসেল বা বৈঠকখানায় পৌঁছত তারা। আর এখন স্বচ্ছ ক্যারিব্যাগে চারদিক চাক্ষুষ করতে করতে ছুটছে তারা।
বর্তমানে মানুষ প্লাস্টিকে মোড়া। মানুষের পায়ের তলা থেকে মাথার ছাদ— সবেতেই প্লাস্টিক। এমনকি মানুষকে দম বন্ধ করে মারার জন্য প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের তুলনা নেই! দোকান গৃহস্থের ঘর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সেই প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ঠাঁই হয় খাল-বিল, নদী-নালা, নর্দমা-পুকুর, মাটির নীচ মাটির উপর। শেষে এই প্লাস্টিক ব্যাগের ঠ্যালায় স্থলে-জলে এই পৃথিবীরই শ্বাস রুদ্ধ। তবুও কি সাধারণ মানুষের হুঁশ হয়েছে? না, হয়নি। এত তাড়াতাড়ি হবেও না। তার কারণ মানুষ অভ্যাসের দাস। মানুষ যাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, সেখান থেকে তার বেরোতে সময় লাগে।
প্লাস্টিকের অনেক সুবিধা আছে। এটি সস্তা হাল্কা, জল, বাতাস নিরোধক। ফলে, এই প্লাস্টিক মানুষের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে উঠতে পেরেছে। ঘর-গেরস্থালি থেকে শুরু করে পায়ের তলা থেকে মাথার ছাদ পর্যন্ত মানুষ প্লাস্টিককে অতি আদরে আপন করে নিয়েছে। এই একটা মাত্র বস্তু অর্থনৈতিক ভাবে না হোক, ব্যবহারের দিক থেকে ভারতের ধনী-দরিদ্রের পার্থক্যকে মুছে দিতে পেরেছে। এক জন হতদরিদ্র মানুষ যখন দেখেন এক জন মারুতি-চড়া মানুষের হাতে তাঁর মতই একটা ক্যারিব্যাগ, তখন তিনি একটু হলেও আত্মপ্রসাদ লাভ করেন এই ভেবে যে, এই একটা ব্যাপারে ওই লোকটার সঙ্গে তাঁর কোনও পার্থক্য নেই।
আমরা জানি পৃথিবীটা গোল আর সে অবিরাম ঘুরে চলেছে পশ্চিম থেকে পুবে। ফলে, পুব ছুটে চলেছে আবার সেই পশ্চিমের দিকেই। এ যেন প্রকৃতির সেই বাই ডিফল্ট নিয়ম যা জন্মলগ্ন থেকেই তৈরি হয়ে এসেছে। এই চির ঘূর্ণায়মান গোলাকার বস্তুটির বুকে জন্ম নেওয়া সমস্ত কিছুই যেন এই নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ। সে সভ্যতা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, দর্শন যাই বলি না কেন, সব কিছুর অভিমুখ যেন পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ভাবে গতিশীল। তবে পশ্চিম বরাবরই একটু মেটেরিয়ালিস্টিক আর পুব বরাবরই আইডিয়ালিস্টিক। পশ্চিম খোঁজে পূবের বস্তুর বাজার আর পুব খোঁজে পশ্চিমে ভাবের বাজার। তাই পশ্চিমে যে বস্তুর বাজারে কদর কমতে থাকে, সেই বস্তু বিক্রি করার জন্য পশ্চিমের কারবারিরা চলে আসে পুবের বাজার ধরতে। ফলে, পশ্চিমের বাজারে যা আবর্জনা পূবের বাজারে তাই বিক্রি হয় সোনা-সোনা করে।
পশ্চিমের দেশগুলো যখন প্লাস্টিকের কুফল সম্পর্কে সচেতন হল, তখন তারা ভারত-চিনের মতো দেশগুলিতে তা পাচার করতে লাগল। প্লাস্টিকের ভাল দিকটাই তুলে ধরা হল এদের কাছে। এ দেশের গরিব সাধারণ মানুষগুলি এই সস্তা প্লাস্টিকের উপরে ভর করে একটু সাবলীল ভাবে বাঁচার পথ খুঁজে পেল। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই মাইক্রন-ফাইক্রন বোঝেন না। পরিবেশ-প্রতিবেশ বুঝতে চায় না। কত মাইক্রনের প্লাস্টিক পরিবেশবান্ধব আর কত মাইক্রন পরিবেশের শত্রু, তাঁরা তা জানতে চান না, বুঝতে চান না। তাঁরা বোঝেন শুধু সুবিধা। যেখানে সুবিধা পাওয়া যাবে সেটাই তাঁদের বান্ধব। প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগে আবর্জনা ভরে তাঁরা নদীতে ফেললেন, না মাটিতে পুঁতে দিলেন— সেটা তাদের কাছে বড় ব্যাপার নয়। তাঁদের কাছে ক্যারিব্যাগে নিতে সুবিধা— সেটাই বড় ব্যাপার। ঠিক সেই কারণে এক সময় প্রাক্তন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব রেলে চায়ের জন্য মাটির ভাঁড় চালু করলেও ধরে রাখতে পারেননি।
রাষ্ট্রের কর্তব্য সমাজের বৃহত্তর অংশের সুবিধার জন্য কাজ করা। তাই সরকারও এক সময় প্লাস্টিককে সাদরে গ্রহণ করেছে। সরকার থেকে আশি বা নব্বইয়ের দশকে বেকার যুবকদের লোনের ব্যবস্থা করা হত প্লাস্টিক বস্তুর কারখানা খোলার জন্য। তখন কি কেউ জানত যে এই প্লাস্টিকই এক দিন এই স্বচ্ছ-সুন্দর পরিবেশের গলার ফাঁস হয়ে উঠবে! যদিও তখন থেকেই পরিবেশবিদগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্কবাণী শোনাতেন। আমরা কি তা শুনেছি? না, শুনতে চেয়েছি?
শুনিনি। শুনতেও চাইনি। শোনার মতো পরিস্থিতিও তখন ছিল না। আজ সাধারণ মানুষ সচেতন হচ্ছেন না বলে চেঁচামেচি করছি। আইন করে ফাইনের ব্যবস্থা করছি। ফাইন কারা দেবেন? সাধারণ মানুষ, সাধারণ দোকানদার। অথচ, কারখানায় এই ক্ষতিকর বস্তুটির ফলন যাতে আর না হয়, সে দিকে নজর দিচ্ছি না। এ যেন অনেকটা সিগারেটের মতো। সতর্কবার্তা লিখেই খালাস! বাজারে থাকবে। আমরা প্রচার করছি— তোমরা খাবে না। সাধুসন্তের দেশ ভারতবর্ষ। আত্মসংযমই বড় কথা।
তবুও আশা রেখে বলছি, শুধুমাত্র পরিবেশবিদদের উদ্যোগ নয়, সাধারণ মানুষের সচেতন অংশগ্রহণ দরকার। সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশাসনের লাগাতার প্রচার এবং প্লাস্টিক দূরীকরণের সক্রিয় উদ্যোগই পারে প্লাস্টিকমুক্ত পরিবেশ ও দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy