বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াইতে হইলেই অতঃপর পিএইচ ডি লাগিবে, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের নবতম সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্ত শুনিয়া শিক্ষকতা এবং পিএইচ ডি নামক ডিগ্রি উভয় বিষয়েই গভীর চিন্তায় ডুবিতে হয়। এমনিতেই ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা ও গবেষণার সম্পর্ক লইয়া অস্বচ্ছতা ও অশান্তির শেষ নাই। তাহার উপর নূতন আর একটি সঙ্কট তৈরি হইল। প্রথম কথা, মন্ত্রী ও তাঁহার উপদেষ্টারা সম্ভবত ধরিয়া লইয়াছেন যে গবেষণা করিলেই ভাল শিক্ষক হওয়া যায়। অথচ বাস্তবে এই দুইটির সম্পর্ক মোটেই তেমন পরিচ্ছন্ন নহে। ভাল গবেষকরা অনেক সময়ই ভাল শিক্ষক হন না, আবার ভাল শিক্ষকরা হয়তো গবেষণায় মন দিতে চাহেন না। আরও এক গোষ্ঠীর সুশিক্ষক আছেন— যাঁহাদের কথা শুনিতে শুনিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভারতীয় বড় হইয়াছেন— তাঁহারা দারুণ নামজাদা শিক্ষক, তদপেক্ষাও ভাল গবেষক তাঁহারা হইতে পারিতেন, হইয়াছেনও, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁহারা পিএইচ ডি-র পিছনে দৌড়াইতে চাহেন নাই। এই মুহূর্তেও এ দেশের বহু বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে এ রকম শিক্ষক আছেন, যাঁহাদের এই ডিগ্রিটি নাই, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কাছে তাঁহারা রত্নখনিসম প্রতিভাত। মূল কথা: শিক্ষকতা এবং গবেষণা, দুইটি সম্পূর্ণ আলাদা মানসপ্রক্রিয়া। ইহাদের মধ্যে সরলরেখা টানিয়া সম্পর্ক রচনার প্রচেষ্টাটি অর্থহীন মূর্খামি।
দ্বিতীয় কথাটি আরও ভয়ের। ধরিয়া লওয়া যায়, ইহার পর হইতে ইউজিসি-র মানদণ্ড অনুযায়ী চাকরিক্ষেত্রে উন্নতি করিবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকমাত্রেই পিএইচ ডির লক্ষ্যে দৌড়াদৌড়ি লাগাইবেন। তাহাতে শিক্ষকতার কোনও ক্ষতি হইবে কি না জানা নাই। কিন্তু পিএইচ ডি ডিগ্রিটির বিস্তর ক্ষতি হইবে। ইতিমধ্যেই গবেষণাপত্রের মান হুহু করিয়া পড়িতে শুরু করিয়াছে, এবং সেই কারণে ডিগ্রিটির মানও কমিতেছে। যে পরিমাণ সময়, শ্রম ও নিষ্ঠা থাকিলে কোনও বিষয়ে সামগ্রিক পড়াশোনার প্রেক্ষিতে ‘ডক্টর’ পদটি অর্জন করা যায়, আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই তাহার ছিটেফোঁটাও থাকে না। এমনকি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলিতেও নয়। ‘গবেষক’ শব্দটি আজ ক্রমশ মূল্যহীন, অথচ আগে গবেষক বলিতে বুঝাইত বিশ্বভোলা সারস্বতসাধক। এখনও সাধকরা আছেন, তবে ডিগ্রিধারীদের ভিড়ে তাঁহাদের খুঁজিয়া পায় কে।
নূতন নিয়ম নিশ্চয় পিএইচ ডি ডিগ্রির এই মূল্যহ্রাসের পরিমাণ আরও দ্রুত বাড়াইয়া দিবে। সরকারি কর্তা-নেতারা বোঝেন না যে সত্যকারের সারস্বত সাধনার সহিত বাহিরের দেনাপাওনার সম্পর্কটি অত্যন্ত দুর্বল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা পড়ান, শিক্ষার্থীরা শেখেন। সেখানে গবেষক-শিক্ষক থাকিলে ভাল, না থাকিলেও ক্ষতি নাই। কিন্তু সব শিক্ষকই যাহাতে নিজের কাজ ঠিক ভাবে করেন, নিজের বিষয়টিতে নূতন নূতন আলাপ-আলোচনার সহিত পরিচিত থাকেন, তাহা নিশ্চিত করা দরকার। এই দরকারি কাজটি করিবার জন্য কিছু পরিদর্শন-পরীক্ষণ চলিতে পারে। কিন্তু গবেষণা বা ডিগ্রি দিয়া তাহা নিশ্চিত করা যায় না। কেননা, নূতন সারস্বত আলোচনার সহিত পরিচয়-বিহীন ভাবেই গবেষণাপত্র রচনা কিংবা ডিগ্রি-সাধনা কত সহজ কাজ, বর্তমান সমাজ তাহা হাড়ে হাড়ে জানে। পণ্ডিত বানাইবার ছলে পাণ্ডিত্য বস্তুটিরই দফারফা হইতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy