মঙ্গলবার অপরাহ্ণে প্রতিস্পর্ধী জনস্রোতের মুখোমুখি সরকারি উদ্যোগে নির্মিত নিরঞ্জন শোভাযাত্রার মঞ্চে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কি মনে মনে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছেন? সমস্যাকে সমস্যা বলে গ্রাহ্য না করার আত্মপ্রসাদ? তিনি কি ভাবছেন, ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক, আমার ভোট আমার দখলেই আছে’? সে ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, প্রশাসকের রাজধর্ম এবং জননেত্রীর মানবধর্ম, কোনওটিই পালন করার সদিচ্ছা তাঁর নেই। আর, তা যদি না হয়, যদি সেই সদিচ্ছার কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকে, তবে অবিলম্বে তার প্রমাণ দেওয়াই তাঁর কর্তব্য। জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবিপত্রকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন চলছে, তার মোকাবিলায় রাজ্য প্রশাসন কখনও নির্মম ঔদাসীন্য দেখিয়েছে, কখনও অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে, কখনও নির্বোধ হঠকারিতায় আন্দোলনের পথ রোধ করতে গিয়ে আদালতের তিরস্কার শুনেছে, কখনও প্রতিবাদীদের একাংশকে অহেতুক গ্রেফতার করে নাগরিক ক্রোধের আগুনে ইন্ধন দিয়েছে। এই গোটা প্রক্রিয়াটিতে দুই তরফের পারস্পরিক আস্থা উত্তরোত্তর কমছে, যে আস্থা সুষ্ঠু প্রশাসনের অপরিহার্য শর্ত। এই আস্থা ফেরানোর প্রধান দায়িত্ব শাসকদের, কারণ তাঁরা শাসক।
মঙ্গলবার অপরাহ্ণে সুপ্রিম কোর্টের শুনানি থেকেও প্রকারান্তরে সেই দায়িত্বের কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক দিকে, সিবিআইয়ের তদন্ত প্রক্রিয়ার উপর সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারি তার নিজস্ব নিয়মেই চলবে, সেই প্রক্রিয়ায় রাজ্য প্রশাসনের যথাযথ সহযোগিতা মিলছে কি না, সেটাও ওই নজরদারির আওতায় পড়বে। পাশাপাশি, সরকারি হাসপাতালে নিরাপত্তাব্যবস্থার অগ্রগতির উপরেও সুপ্রিম কোর্ট নজর রাখছে, সিভিক ‘পুলিশ’ সংক্রান্ত নির্দেশ কার্যত তারই অঙ্গ। নজরদারি চলছে কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থার প্রস্তুতির উপরেও। অন্য দিকে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আদালত নিজেকে জড়াতে নারাজ। সুপ্রিম কোর্টের এই অবস্থান একটি কথা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়: সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সামগ্রিক আয়োজনটির বিশদ সংস্কারের দায়িত্ব রাজ্য সরকারেরই। লক্ষণীয়, সেই দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করা হলে জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবিপত্রেরও জবাব মিলবে।
এখানেই প্রশাসনের প্রকৃত কাজ। প্রথমত, কোনও কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে আপস না করে সততার সঙ্গে প্রকৃত সংস্কারের আয়োজন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই বিষয়ে কেবল প্রতিবাদী চিকিৎসকদের নয়, বৃহত্তর সমাজকেও অবহিত রাখতে হবে। টাস্ক ফোর্স গঠন করে দেওয়া হয়েছে, হাসপাতালে নিরাপত্তাব্যবস্থার ৯০ থেকে ৯৮ শতাংশ প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে, কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থার (অর্ধপক্ব) পরীক্ষামূলক আয়োজন চালু করা হচ্ছে— ইত্যাকার অনির্দিষ্ট এবং অস্পষ্ট কথা বলে পরিস্থিতি ‘ম্যানেজ’ করা যাবে না। প্রশাসনের চালকদের কথায় বিশ্বাস না রাখতে পারার প্রভূত কারণ আছে। তাঁদের প্রথম কাজ নিজেদের সংশোধন করা, অস্বচ্ছ কৌশলের রাস্তা ছেড়ে স্বচ্ছ আলোচনার পথে আসা। অন্য দিকে, আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসক এবং তাঁদের প্রবীণতর উপদেষ্টা বা নেপথ্য-চালকদেরও আন্দোলন-সর্বস্ব নেতিবাচক প্রতিস্পর্ধার বৃত্ত থেকে এখনই নিষ্ক্রান্ত হওয়া দরকার। কেবল বিপজ্জনক এবং হঠকারী আমরণ অনশন প্রত্যাহার করা জরুরি নয়, প্রশাসনের সঙ্গে সত্যকারের গঠনমূলক আলোচনার পথে পূর্ণশক্তিতে যোগ দেওয়ার দায়িত্বও সত্বর তাঁদের নিতে হবে। সমালোচনা এবং চাপসৃষ্টি তার গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ, কিন্তু সেটাই এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। বাস্তবিক, উচ্ছ্বসিত জন-আবেগে ভর করে রাস্তার জনজোয়ারের গৌরবে শাসকদের ‘হারিয়ে দেওয়া’র আত্মপ্রসাদ একটি সম্ভাবনাময় সামাজিক আন্দোলনের প্রকৃত লক্ষ্যকে ভুলিয়ে দিতে পারে। আপনবেগে পাগলপারা হয়ে পড়ার সেই দুর্লক্ষণগুলি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। উত্তরণের পথ যেন কানাগলিতে পর্যবসিত না হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy