Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
UAPA

গণতন্ত্রের কলঙ্ক

২০১৯ হইতে এই অবধি ইউএপিএ মোতাবেক রুজু হওয়া মামলার সংখ্যা ৭২ শতাংশ বাড়িয়া গিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২১ ০৫:৩০
Share: Save:

মহাবীর নারওয়াল তাঁহার কন্যাকে শেষ দেখা দেখিতে পান নাই। নাগরিকত্ব নির্ধারণের নামে রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শামিল, জেএনইউয়ের ছাত্রী এবং ‘পিঞ্জরা তোড়’ গোষ্ঠীর সদস্য, নাতাশাকে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করে পুলিশ, তাঁহার বিরুদ্ধে ইউএপিএ নামক দমনমূলক আইনটিও প্রয়োগ করা হয়। নাতাশা ইতিমধ্যে প্রায় এক বছর ‘বিচারাধীন’ কয়েদি হিসাবে কাটাইয়াছেন। তিনি যাহাতে অসুস্থ, কোভিড-আক্রান্ত বৃদ্ধ পিতাকে মৃত্যুশয্যায় এক বার দেখিতে পান, তাঁহার বন্ধু, সহকর্মী এবং মানবাধিকার কর্মীরা তাহার জন্য উদ্যোগী হইয়াছিলেন। অবশেষে, মহাবীর নারওয়ালের মৃত্যুর পরে, তাঁহার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় থাকিবার জন্য তিন সপ্তাহের জামিন পাইয়াছেন নাতাশা। বর্তমান ভারতে এই প্রাপ্তিও রীতিমতো দুর্লভ বইকি। গত কয়েক দিনে আরও এক বন্দি অভিযুক্তের কথা প্রচারিত হইয়াছে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বন্দি এবং বিচারাধীন অধ্যাপক হানি বাবু শারীরিক ভাবে অত্যন্ত অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও, সম্ভবত কোভিড সংক্রমণ সত্ত্বেও, তাঁহাকে জামিন দেওয়া হয় নাই। অতিপ্রবীণ, অসুস্থ স্ট্যান স্বামীর যন্ত্রণার কাহিনি সর্বজনবিদিত। সুপরিচিত এমন আরও বহু নিপীড়নের বৃত্তান্ত।

রাষ্ট্রের নীতি ও আচরণের প্রতিবাদ করিলে ভীতিপ্রদর্শন এবং নিপীড়নের উদ্দেশ্যে বিবিধ দমনমূলক আইনের প্রাদুর্ভাব এবং সেই সব আইনে আটক করিয়া বহু মানুষকে দীর্ঘকাল বন্দি রাখিবার প্রবণতা এই দেশে নূতন নহে। কিন্তু এই বিষয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠীর অসহিষ্ণুতা এবং দমন-নিপীড়নের তৎপরতার কোনও তুলনা নাই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক প্রদত্ত সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলিতেছে, ২০১৯ হইতে এই অবধি ইউএপিএ মোতাবেক রুজু হওয়া মামলার সংখ্যা ৭২ শতাংশ বাড়িয়া গিয়াছে। ইহাও লক্ষণীয় যে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আইন সংশোধন করিয়া ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করিবার অধিকারও ইতিমধ্যে হস্তগত করিয়াছে। স্পষ্টতই, রাষ্ট্রক্ষমতার সুযোগে শাসকরা আইনকে পীড়নের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করিতে বদ্ধপরিকর। অভূতপূর্ব অতিমারির বিভীষিকাও রাষ্ট্রীয় পীড়নের স্পৃহাকে এতটুকু কমাইতে পারে নাই। পারিলে, অন্তত বিচারাধীন বন্দিদের একটি বড় অংশ যাহাতে জামিন পান, সরকার নিজেই তাহার জন্য তৎপর হইত।

এই দেশে বিপুলসংখ্যক অভিযুক্ত দীর্ঘ হইতে অতিদীর্ঘ সময় বিচারাধীন অবস্থায় বন্দি থাকেন। এই রীতির মৌলিক অন্যায্যতা লইয়া বহু প্রতিবাদ হইয়াছে, সর্বোচ্চ আদালত স্বয়ং এই বিষয়ে বারংবার খেদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছে। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার সমস্যা এই ক্ষেত্রে অনেকখানি দায়ী। কিন্তু দায়ের সিংহভাগ বর্তায় শাসনবিভাগের উপর। বিশেষত, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ‘অপরাধে’ চণ্ডনীতি প্রয়োগ করিয়া নাগরিকদের গ্রেফতার করা এবং তাঁহাদের কয়েদ করিয়া রাখা— যথার্থ গণতন্ত্রে এই অন্যায়ের কোনও ক্ষমা থাকিতে পারে না। লক্ষণীয়, রাষ্ট্র যাঁহাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের মামলা দায়ের করিতেছে, রাষ্ট্রের পুলিশ বা গোয়েন্দা বাহিনী দীর্ঘকাল ধরিয়া তাঁহাদের অনেকের বিরুদ্ধেই আদালতগ্রাহ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করিতে অপারগ হয়, অনেক সময়েই সেই অপারগতার কারণে অভিযোগ খারিজ হইয়া যায়। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, অনেক অভিযুক্তেরই প্রকৃত অপরাধ— তাঁহারা রাষ্ট্রের অন্যায়ে সায় দেন নাই, নীরব থাকেন নাই। অর্থাৎ, তাঁহারা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকের কর্তব্য পালন করিয়াছিলেন। বর্তমান শাসকরা যে সরকারের বিরোধিতাকেই রাষ্ট্রদ্রোহ মনে করেন, মন্ত্রী-সান্ত্রিদের অনেকের কথাতেই তাহা ক্রমাগত ফাঁস হইয়া যায়। এই অন্ধকার হইতে ভারতকে যদি মুক্তি খুঁজিতে হয়, তবে মৌলিক পরিবর্তনের দাবি জানাইতে হইবে। কেবল ইউএপিএ বা আফস্পার মতো দমন আইন নহে, ‘সিডিশন’ বা রাষ্ট্রদ্রোহের ধারণাটিকেই আইনের কেতাব হইতে বিসর্জন দেওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলন তৈয়ারি করা জরুরি। প্রসঙ্গত, ১৯৫১ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রদ্রোহ আইনকে ‘জঘন্য’ (অবনকশাস) আখ্যা দিয়াছিলেন। ভারতের দুর্ভাগ্য, সেই নিন্দা তাঁহার ব্যক্তিগত উচ্চারণ হিসাবেই থাকিয়া গিয়াছে, নেহরুও আইনটি রদ করিতে উদ্যোগী হন নাই। নরেন্দ্র মোদী বা তাঁহার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট সেই উদ্যোগের প্রত্যাশা পাগলেও করিবে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভারতের কর্তব্য, এই বিষয়ে জোরদার দাবি তোলা। সেই দাবি হইতে পারে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি উদ্‌যাপনের একটি উজ্জ্বল মাইলফলক।

যৎকি‌ঞ্চিৎ

প্রশাসন যখন সবাইকে ঘরে থাকতে অনুরোধ করে হয়রান, তখন এক প্রবীণ নাগরিক, অকারণেই, শীতলখুচি থেকে নন্দীগ্রাম দৌড়োচ্ছেন। এই কি সময় আন্তরিক পর্যটনের? রাজ্যপালকে মনে রাখতে হবে, টিকাকরণ হয়ে গেলেও বাড়ির বাইরে না বেরোনোই মঙ্গল। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। মান, অপমান, সবই এখন লাটভবনের চৌহদ্দিতে রাখা বিধেয়। এটুকু নিয়ম সব নাগরিকের জন্য। আর, রাজ্যপাল পদে থাকলে রাজনৈতিক দূরত্ব বজায় রাখাও সমান প্রয়োজন।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Narendra Modi NRC UAPA CAA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy