অস্পৃশ্যতা ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী যতই ‘নিষিদ্ধ’ হোক, এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও তার প্রবল উপস্থিতি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গকে এই ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম মনে করা হত। অস্পৃশ্যতা অন্য রাজ্যগুলির মতো এই রাজ্যে তেমন শিকড় বিস্তার করতে পারেনি— এমনই ছিল ধারণা, যা জোর ধাক্কা খেয়েছে সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমানের একটি শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে। কাটোয়ার গীধগ্রামে বহু প্রাচীন মন্দিরটিতে প্রবেশাধিকারের দাবিতে পথে নেমেছেন দাসপাড়ার শতাধিক দলিত পরিবার। অভিযোগ— বছরের পর বছর ধরে তাঁদের মন্দিরে প্রবেশ করা বা পুজো দেওয়া তো দূর স্থান, মন্দিরের সিঁড়িতে পা দেওয়ার অধিকারটুকুও ছিল না। এই অন্যায় প্রথা বন্ধ করতে এবং শিবরাত্রির দিন পুজোর অধিকার চেয়ে তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনিক পদাধিকারী এবং পুলিশের কাছে চিঠি লেখেন। তদনুযায়ী পুলিশ-প্রশাসন দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে। সিদ্ধান্ত হয় পুজোর অধিকার সকলেই পাবেন। কিন্তু অভিযোগ, দাসপাড়ার বাসিন্দাদের জন্য মন্দিরের তালা খোলেনি। অতঃপর দীর্ঘ দিনের প্রথা, সমানাধিকারের দাবি এবং অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে ফের উত্তপ্ত হয়েছে সমগ্র এলাকা।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় সংবিধানের ১৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ভারতে যে কোনও রূপে অস্পৃশ্যতার চর্চা নিষিদ্ধ। ১৯৫৫ সালে পাশ হয়েছিল অস্পৃশ্যতা নিরোধক আইন, যেখানে অস্পৃশ্যতার চর্চাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়েছিল। আইন অনুযায়ী, ধর্মস্থানে, জনপরিসরে, অথবা গণপরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কাউকে বাধাদান শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ভারতও সংবিধানের ধারা, আইন— কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। উত্তর থেকে দক্ষিণ— ভারতের রাজনীতিতে উচ্চবর্ণের আধিপত্য, জাতব্যবস্থায় অবাধ প্রশ্রয়দান এই অন্যায়কে সমানে অক্সিজেন জুগিয়েছে। তারই পরিণতি— কখনও পানীয় জলের বালতি ছোঁয়া, কখনও নিছক সন্দেহের বশে দলিত শিশু থেকে বৃদ্ধদের নির্যাতন, দলিত মেয়েদের ধর্ষণ। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার না পাওয়াও এই দেশে স্বাভাবিকতায় পরিণত। এই কি তবে আধুনিক যুক্তিবাদী ভারত?
এবং পশ্চিমবঙ্গও এই তালিকার একেবারে বাইরে ছিল না। ২০০১ সালে প্রতীচী ট্রাস্টের এক সমীক্ষা দেখিয়েছিল, কিছু বিদ্যালয়ে তফসিলি জাতিভুক্ত শিক্ষার্থীদের আলাদা বসতে বাধ্য করা হয়। স্কুলে নিচু বর্ণের মহিলাদের রান্না করা খাবার খেতে অভিভাবকরা আপত্তি জানিয়েছেন— এ অভিযোগও পূর্বে উঠেছে। ২০১৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের উদ্দেশে জাত তুলে কটাক্ষের অভিযোগ উঠেছিল শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় একের পর এক অধ্যাপক তাঁদের পদত্যাগপত্র পাঠান উপাচার্যের কাছে। পরিস্থিতি সামলাতে আসরে নামেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতেও রয়েছে এই বৈষম্য। এই রাজ্যে দলিত সাহিত্যিকদের রচনা আজও সীমিত সংখ্যক পাঠকের মধ্যেই আবদ্ধ। বাম রাজনীতি এবং আলোকপ্রাপ্ত উচ্চবর্ণের শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির অতিরিক্ত দৃশ্যমানতা এই অসাম্যের চিত্রটি প্রকট হতে দেয়নি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তা প্রবল ভাবেই উপস্থিত ছিল, আজও আছে। পূর্ব বর্ধমান তার নিদর্শন তুলে ধরল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)