আশ্বাস ছিল যথেষ্ট, আশাও ছিল খানিক। হয়তো কড়া হবে প্রশাসন, হুল্লোড়প্রেমী জনতাকে শৃঙ্খলা মেনেই উৎসবে শামিল হতে বাধ্য করবে। স্বয়ং লালবাজার জানিয়েছিল, দোলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে এবং ট্র্যাফিক আইন ভাঙা রুখতে ২৮০০ পুলিশকর্মীকে রাস্তায় নামানো হবে। কার্যক্ষেত্রে অবশ্য পুলিশের সেই কঠোর কর্তব্যপরায়ণ রূপটি দেখার সৌভাগ্য নাগরিকের তেমন হয়নি। বরং, প্রতি উৎসবে এই বঙ্গ যা নিয়ম করে ফেলেছে, দোল উৎসবও তার সাক্ষী রইল। উৎসবপ্রেমীরা পথে নেমে দেদার আইন ভাঙলেন, পুলিশ প্রধানত নীরব দর্শক হয়েই রইল, এবং উৎসব-শেষে পুলিশের পক্ষ থেকে বিশৃঙ্খলার ঘটনাগুলিকে বিক্ষিপ্ত বলে গ্রেফতার এবং মদ বাজেয়াপ্ত করার পরিসংখ্যান দিয়েই দায় সারা হল।
প্রসঙ্গত, বিধিভঙ্গকারী যদি জোর গলায় দাবি করেন— উৎসব মানে সবেতে ছাড়, এ বছরও কেউ আটকায়নি, কেউ আটকাবে না— তবে যে তা প্রশাসনিক ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তোলে, সে কথাটি পুলিশ-প্রশাসনকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভাল। দোলে বিধিভঙ্গ কোন পর্যায়ে যেতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে সেটি যে শুধুমাত্র ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকে না— সে কথাটি তাঁদের চেয়ে ভাল আর কেউ জানে না। সেখানে পুলিশের ভূমিকা যদি এরূপ নিষ্ক্রিয় বলেই প্রতিভাত হয়ে থাকে, তবে উৎসবের পরিস্থিতি যে কোনও সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। প্রতীক্ষা কি তবে সেই দিনের? উৎসবের দিনে পুলিশ যে লাঠি হাতে পথ শাসনে নামবে না— এটি যেমন স্বাভাবিক; ঠিক তেমনই স্বাভাবিক হেলমেট পরা, গতিবিধি মেনে চলা, সিগন্যাল না-ভাঙা— এই সাধারণ বিষয়গুলি যাতে অন্য দিনের মতোই পালিত হয়, সেটি নিশ্চিত করা। কারণ এই প্রাত্যহিক বিষয়গুলির সঙ্গে পথে বার হওয়া অন্য নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি যুক্ত। যে-হেতু নিরাপত্তার দায়িত্বটি প্রাথমিক ভাবে পুলিশ উপরেই ন্যস্ত, সুতরাং সেই কাজে ফাঁকি দিলে চলে না। উৎসবের দিন হলেও না। পুলিশের কর্তব্যের গুরুত্ব বোঝাতে একটি কথা প্রায়ই তুলে ধরা হয়— অন্যরা যখন নিশ্চিন্তে উৎসবে গা ভাসান, তখনও পুলিশকে পরিবার ফেলে তাঁর ডিউটি করে যেতে হয়। পুলিশের ‘ডিউটি’ যাতে শেষ পর্যন্ত জনমানসে প্রহসনে পরিণত না হয়, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এই বিভাগেরই। দুর্ভাগ্য, একমাত্র দুর্গাপুজো ছাড়া পুলিশের সেই কর্তব্যনিষ্ঠ ভূমিকা সাম্প্রতিক কালে বিশেষ চোখে পড়ে না।
বরং, আতঙ্ক জাগায় উৎসবের নামে পরিবেশ ধ্বংসের প্রতি প্রশাসনের অবাধ প্রশ্রয় দান। দোলের পূর্বে সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় আলোচিত হয়েছিল পরিবেশগত কারণকে মাথায় রেখে বন দফতরের পক্ষ থেকে শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরির হাটে দোল খেলা নিষিদ্ধ করার বিষয়টি (‘রঙিন হুল্লোড়’, ১৩-৩)। ‘প্রশাসনিক তৎপরতা’য় সে নিষেধাজ্ঞা তার অব্যবহিত পরেই উঠে যায়। উঠে যায় প্রকৃতি বাঁচানো সংক্রান্ত পোস্টারগুলিও। অতঃপর জঙ্গলে প্লাস্টিক ছড়িয়ে, পলাশের ডাল ভেঙে মচ্ছব চলেছে দিনভর। এবং এই চিত্র শুধুমাত্র দোলের নয়। প্রতি বছর কালীপুজো, বড়দিন, ইংরেজি নববর্ষ-সহ সমস্ত উৎসবে উন্মুক্ত প্রান্তরকে আবর্জনায় ভরিয়ে তোলাই নাগরিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশপ্রেমীরা লড়ছেন। প্রশাসন শুনছে কি?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)