ভারতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কত, সেই পুরনো প্রশ্ন আবারও উঠল। প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শমিকা রবি দাবি করেছেন, ২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪’এর মধ্যে ৩০ কোটি মানুষ দারিদ্র থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারকদের দাবি, মোদীর সুপ্রশাসনের গুণে ভারতে দরিদ্র মানুষ এখন ৪ শতাংশ, বা তারও কম। এই সরকারের পক্ষে এমন দাবি নতুন নয়, অপ্রত্যাশিতও নয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের তিন মাস আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন, তাঁর দশ বছরের শাসনকালে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দারিদ্রের কবল থেকে বেরিয়েছেন। দাঁড়িপাল্লা, বাটখারা আর দোকানি, প্রতিটির প্রতি সন্দেহ প্রবল হলে ক্রেতার যে দশা হয়, ভারতে দারিদ্রের সরকারি পরিমাপ জেনে তেমনই বিমূঢ়, বিরক্ত হয়েছিলেন দেশবাসী। প্রশ্ন উঠেছিল, দারিদ্র মাপার আন্তর্জাতিক সূচকগুলির সঙ্গে কেন ইচ্ছেমতো নতুন সূচক যোগ করছে কেন্দ্র? দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করতে রোজগারের যে সীমা অতীতে নির্ধারিত হয়েছিল, মূল্যস্ফীতির নিরিখে তাতে কতটা কী বদল আনা হল, কিসের ভিত্তিতে বদল করা হল, তা স্পষ্ট না করেই এমন পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হল কেন? ২০১১ সালের জনগণনার ভিত্তিতে ২০২০-পরবর্তী সময়ে দারিদ্র কমার হিসাব, এবং দারিদ্রের পরিমাপে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান ব্যবহার, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সর্বোপরি, দারিদ্র মাপার বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় সরকারের কয়েকটি মন্ত্রক আর নীতি আয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে একটা রহস্যময় মন্ত্রণার আকার দেওয়া হয়েছে। মাঝেমাঝে কিছু তাক-লাগানো পরিসংখ্যান স্ফুলিঙ্গের মতো গণমাধ্যমে উঠে এসে, চার দিক থেকে নানা প্রশ্নের সামনে পড়ে, নিরুত্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নীতি নিয়ে সরকার ও নাগরিকের কোনও সংলাপ গড়ে উঠছে না। দারিদ্র নিরসনে ব্যর্থতা ঢাকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চলছে পরিসংখ্যান নির্মাণের সরকারি কর্মশালা।
দারিদ্রসীমা নিয়ে রাজনীতির খেলা নতুন নয়। ২০১৪ সালে যোজনা কমিশন ঘোষণা করেছিল, ইউপিএ আমলে জনসংখ্যায় দরিদ্রের অনুপাত ৩৭ শতাংশ (২০০৪-০৫) থেকে কমেছে ২২ শতাংশে (২০১১-১২)। তখন বিজেপি অভিযোগ করেছিল, দারিদ্রের সংজ্ঞা বদলে দিয়ে দারিদ্র কমাচ্ছে ইউপিএ সরকার। আজ বিজেপি সরকার দারিদ্রের সূচকই বদলে দিচ্ছে। দারিদ্রের যে বহুমুখী সূচক ব্যবহার করে রাষ্ট্রপুঞ্জ, তাতে রয়েছে দশটি বিষয়। বিজেপি সরকার যোগ করেছে আরও দু’টি— ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, এবং প্রাক্-প্রসব পরিষেবা। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ব্যাঙ্কগুলি জনধন অ্যাকাউন্ট খোলায় অধিকাংশ ভারতীয়ের এখন অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যদিও তাতে টাকা রয়েছে শূন্য, বা সামান্য। অন্য দিকে, আশা-অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দিয়ে প্রাক্-প্রসব পরিষেবা বিস্তৃত করা হলেও প্রসূতি মৃত্যুর হার কমেনি। নবজাতকের ওজনে ঘাটতি, শিশু-অপুষ্টি প্রভৃতির জাতীয় হারেও উন্নতি হয়নি। তা সত্ত্বেও দারিদ্র নিরসনে ‘উন্নতি’ দেখাতে পারছে সরকার। যেন পরীক্ষার্থী নিজেই নিজের প্রশ্নপত্র তৈরি করছে, নিজেই মূল্যায়ন করছে।
এমন সরকারি পরিসংখ্যান স্বয়ং সরকারও কাজে প্রয়োগ করতে পারে না। নীতি আয়োগের মতে দারিদ্রসীমার নীচে রয়েছেন একশো জনে চার জন, অথচ সরকারি ভর্তুকিতে খাদ্যশস্য পাচ্ছেন একশো জনে ষাট জন। মহিলাদের সরকারি অনুদান দেওয়ার প্রচলন বাড়ছে। কারণটা বোঝা সহজ, কোন রাজনৈতিক দল দরিদ্রের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে টিকে থাকতে পারে? ভারতে অতি-দরিদ্রের অনুপাত আগের চেয়ে কমছে, তা বিশ্ব ব্যাঙ্ক-সহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থাও স্বীকার করে। কিন্তু যে বিপুল হ্রাস দাবি করছে কেন্দ্র, কোনও মূল্যায়নে তার স্বীকৃতি মেলে না। ভারতের ১৫ শতাংশ মানুষ এখনও মাসে পাঁচ হাজার টাকার কম আয় করেন, এ-ও কিন্তু সরকারি সমীক্ষারই (এসইসিসি) পরিসংখ্যান।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)