তাঁর স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির কারণ দেখিয়ে স্থায়ী জামিনের আবেদন পেশ করা হয়েছিল আদালতে। আবেদন করা হয়েছিল, মুম্বইয়ের ভাড়াবাড়িতে নয়, তেলঙ্গানায় নিজের বাড়িতেই তাঁকে থাকতে দেওয়া হোক। ভীমা কোরেগাঁও-এলগার পরিষদ মামলায় অভিযুক্ত ভারাভারা রাওয়ের সেই আবেদনের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি, তার আগে তিরাশি বছর বয়স্ক কবিকে এ বার আদালতে শুনতে হল, তাঁর অপরাধ এতই গুরুতর যে, তার সঙ্গে এ দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে, এবং সেই অপরাধে তাঁর ‘সর্বোচ্চ শাস্তি তথা মৃত্যুদণ্ড’ পর্যন্ত হতে পারে! জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র আইনজীবী এই যুক্তি দেখিয়েই অশীতিপর কবির স্থায়ী জামিনের বিরোধিতা করেছেন, স্বগৃহে থাকারও।
তা হলে এমন পরিস্থিতিও হল এ দেশে, যাতে কবির মৃত্যুদণ্ড চাওয়া যায়। নাট্যমঞ্চ বা রুপোলি পর্দায় অভিনয় নয়, এই হল ঘটমান বাস্তব। এমন কথা প্রকাশ্যে জোর দিয়ে বলতে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার বিন্দুমাত্র ভাবান্তর ঘটছে না— এ এক চরম অশনিসঙ্কেত। আদালতে আইনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুক্তিজাল সাজাতে আইনজীবীকে কঠিন বাক্য উচ্চারণ করতে হয় সত্য, যে আইনবলে ভারাভারা রাওকে বন্দি করা হয়েছে সেই ইউএপিএ আইনের অতিকঠোর চরিত্রের সঙ্গেও হয়তো এই শব্দগুচ্ছ সমঞ্জস। কিন্তু কাঠগড়ায় উপস্থিত অশীতিপর, চরম অসুস্থ, তাঁর আইনজীবীর বয়ানে পারকিনসন’স রোগে আক্রান্ত এক বিচারাধীন কবির উপর এই কথার মানসিক অভিঘাত কেমন হতে পারে, অনুভূতিবোধসম্পন্ন মানুষ তা অনুমান করতে পারবেন। ফিয়োদর দস্তয়েভস্কি শাসকের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন, শেষ মুহূর্তের নাটকীয় পটপরিবর্তনে। লেখক-কবি-চিন্তককে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তিদানের নির্মম উদাহরণ বিরল নয়, সাক্ষী সক্রেটিস থেকে গার্সিয়া লোরকার মৃত্যু। কিন্তু মনে রাখা দরকার সেই ঘটনাগুলির সময়কাল ও শাসক-চরিত্রের কথাও: দস্তয়েভস্কি অভিযুক্ত হয়েছিলেন জ়ারের রাশিয়ায়, সক্রেটিস সুদূর অতীত-সভ্যতায়, গার্সিয়া লোরকা ফ্যাসিবাদী জমানায়। ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে, ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বলে গর্ব করা এই ভারতে যখন এক অশীতিপর কবিকে দেশের নিরাপত্তার খাতিরে মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাব্য শাস্তির ভয় দেখাতে হয়, তখন রাষ্ট্র ও শাসকের চরিত্র সম্পর্কে আর বোঝার কিছু বাকি থাকে কি?
ঘটনা হল, কবি ভারাভারা রাও এতটাই অসুস্থ যে, তাঁকে জেলে রাখাই অসম্ভব, আদালত নিজেই এক অর্ডারে জানিয়েছে। সাময়িক জামিনে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এই কারণেই। কিন্তু এ বার প্রশ্ন উঠেছে স্থায়ী জামিন নিয়ে। স্থায়ী জামিনের প্রশ্নে খোদ হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চই এনআইএ-কে মনে করিয়ে দিয়েছে, ‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিয়োর’ (সিআরপিসি)-এর ৪৩৭ ধারা অনুযায়ী বিশেষ পরিস্থিতিতে ও অভিযুক্তের অসুস্থতার কারণে স্থায়ী জামিনের ব্যবস্থা রয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বিভিন্ন মামলাসূত্রে একাধিক বার বলেছে, অভিযোগ প্রমাণিত না হলে জামিনই নিয়ম হওয়া উচিত। তদুপরি এখানে অভিযুক্ত এক জন অশীতিপর গুরুতর অসুস্থ বৃদ্ধ, যাঁর জামিন হওয়া উচিত মানবাধিকার অনুসারেই। ভারতীয় রাষ্ট্র নিজেকে কোন অমানবিক তলে নামিয়ে এনেছে, এই একটি ঘটনাই তার প্রমাণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy