Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
coronavirus

শিক্ষা অভিযান

সঙ্কট মানুষ চিনাইয়া দেয়। অতিমারির মহাসঙ্কটে সমাজ সুশিক্ষকদের চিনিয়া লইয়াছে।

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৪:৫৪
Share: Save:

অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত মহাশয় আট দশক নামাঙ্কিত আত্মকথায় জানাইয়াছিলেন, শিক্ষকজীবনের ছাত্রছাত্রীদের লইয়াই তাঁহার গর্ব, তাঁহাদের জ্ঞানের প্রসারে, চিন্তার সমৃদ্ধিতে এবং গবেষণার স্বীকৃতিতেই তিনি আনন্দিত ও চরিতার্থ বোধ করেন। এই সার্থকতার বোধটি যথার্থ শিক্ষকের স্বধর্ম, এই বোধই তাঁহার শিক্ষক-সত্তাকে ধারণ করিয়া রাখে, তাঁহার কর্মযোগের প্রেরণা দেয়। সকল শিক্ষক এই ধর্মের প্রতি সমান নিষ্ঠাবান থাকিতে পারেন বা চাহেন, এমন নহে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে তফাত ঘটে, অনেক সময় বড় রকমের তফাত। কিন্তু সেই তারতম্য যে কোনও বৃত্তিতেই সত্য ও স্বাভাবিক। তাহাতে বৃত্তি বা সত্তার ধর্ম অসত্য হইয়া যায় না। তবে, অন্য অনেক বৃত্তির সহিত শিক্ষকতার একটি মৌলিক পার্থক্যও অনস্বীকার্য। সুশিক্ষক কেবল বৃত্তি নির্বাহ করেন না, এক ধরনের ব্রত পালন করেন। মানুষ গড়িবার ব্রত। কালক্রমে সেই ব্রতের পরিবেশে ও পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তর পরিবর্তন ঘটিয়াছে, বিশেষ করিয়া শিক্ষাকে পেশা-প্রাপ্তির প্রকরণ হিসাবে দেখিবার প্রবণতা উত্তরোত্তর জোরদার হওয়ার ফলে শিক্ষকের ভূমিকা বহুলাংশেই পরীক্ষায় ভাল নম্বর প্রাপ্তির কৌশল শিখাইবার চাকুরিতে রূপান্তরিত হইয়াছে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও, এবং বিবিধ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যেও, আজও এমন শিক্ষকের দেখা মিলিয়া থাকে যিনি আপন তাগিদেই ছাত্রছাত্রীদের মানসিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন, তাহাদের সাফল্যেই আপনাকে সার্থক বলিয়া গণ্য করেন। প্রাথমিক স্তর হইতে শুরু করিয়া শিক্ষার সমস্ত পর্যায়েই এই প্রকৃত শিক্ষাব্রতীরা সুলভ না হইলেও, বিরল নহেন। শিক্ষক দিবসে তাঁহাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।

সঙ্কট মানুষ চিনাইয়া দেয়। অতিমারির মহাসঙ্কটে সমাজ সুশিক্ষকদের চিনিয়া লইয়াছে। এই সঙ্কটে স্কুল-কলেজের পঠনপাঠন বিপর্যস্ত। বিশেষত ভারতের মতো দেশে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ছাত্রছাত্রীদের এক বিরাট অংশ ডিজিটাল মাধ্যমে পড়াশোনা চালাইবার সুযোগ হইতে বহুলাংশে বা সর্বাংশে বঞ্চিত, সুতরাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকিবার ফলে তাহাদের পড়াশোনা কার্যত বা সম্পূর্ণত বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ৫ সেপ্টেম্বর তারিখটির মর্যাদা স্মরণে রাখিয়াও, বস্তুত তাহা স্মরণে রাখিয়াই, এই অপ্রিয় সত্য স্পষ্ট ভাবে বলা আবশ্যক যে, শিক্ষকদের একটি অংশ এই দীর্ঘ অতিমারির সময়টিকে যথাসম্ভব অবকাশ হিসাবেই যাপন করিয়া আসিতেছেন এবং ইহাতে তাঁহাদের কিছুমাত্র অনুপপত্তি নাই। তাঁহারা শিক্ষকতার চাকুরি করেন, এইমাত্র। কিন্তু তাহার পাশাপাশি রহিয়াছেন এমন বহু শিক্ষক, যাঁহারা অভূতপূর্ব এবং অভাবিতপূর্ব সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়াইয়া ছাত্রছাত্রীদের নিকট পৌঁছাইবার এবং তাহাদের শিক্ষাকে যথাসম্ভব সচল রাখিবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন, অনেক সময়ে আপন স্বাস্থ্যের ঝুঁকি লইতে দ্বিধা বোধ করেন নাই। লক্ষ করিবার বিষয়, এবং আক্ষেপ করিবার বিষয়ও বটে যে, এই ধরনের উদ্যোগে রাজ্য সরকার তথা বিভিন্ন স্তরের প্রশাসন ও ক্ষমতাশালী রাজনীতিকরা যে সহযোগিতা করিতে পারিতেন, তাহা সচরাচর পাওয়া যায় নাই, এমনকি উৎসাহী ও উদ্যোগী শিক্ষকদের সরাসরি বা প্রকারান্তরে বাধা দিবার ও নিরুৎসাহ করিবার নজিরও বিরল নহে।

আশার কথা, এই প্রতিকূলতা উৎসাহ ও উদ্যোগকে দমন করিতে পারে নাই, অতিমারির মধ্যে এবং তাহার পরবর্তী পর্বে কী ভাবে পঠনপাঠনের কাজটিকে চালু রাখা যায়, কী ভাবে দীর্ঘ সময়ের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করিতে শিক্ষার্থীদের সহায় হওয়া যায়, তাহার জন্য বহু শিক্ষক একক এবং সমবেত ভাবে চিন্তাভাবনা করিতেছেন, প্রস্তুতি চালাইতেছেন। আশা করা যায়, তাঁহাদের এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজের এই আগ্রহ ও প্রচেষ্টা রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকদেরও কিছুটা সচেতন করিবে, তাঁহারা শিক্ষার প্রতি নিজেদের লজ্জাকর ঔদাসীন্যের ইতিহাস পরিবর্তনে অংশত তৎপর হইবেন, অন্তত আগ্রহী শিক্ষকদের বাধা না দিয়া পাশে দাঁড়াইবেন। শিক্ষার যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই ঘটিয়া গিয়াছে, তাহাকে সামাল দিবার জন্য অবিলম্বে সমাজ এবং প্রশাসনের পূর্ণোদ্যমে তৎপর হওয়া জরুরি। এই কর্মকাণ্ডে স্বাভাবিক নেতৃত্বের ভূমিকা লইতে হইবে সুশিক্ষকদের। বস্তুত, তাঁহাদের নেতৃত্বে একটি যথার্থ শিক্ষা অভিযান শুরু করা আবশ্যক, যে অভিযান একটি যথার্থ সামাজিক আন্দোলনের অনুঘটক হইতে পারে। যদি পশ্চিমবঙ্গের সমাজ এই কাজ করিতে পারে, তাহাই হইবে শিক্ষক দিবসের প্রকৃত উদ্‌যাপন।

যৎকিঞ্চিৎ

আয় বাড়াতে মেট্রো স্টেশনের নাম ভাড়া দেওয়া হচ্ছে নানা বাণিজ্যিক সংস্থাকে। চাঁদনি চক ভাড়া পেয়েছে এক ইস্পাত সংস্থা, শোভাবাজার-সুতানুটি এক গয়না-গড়িয়ে, ফুলবাগানে ফুটেছে জীবন বিমার ফুল। এ বার স্টেশনের নামের আগে বসবে সংস্থার নাম, ফুটবল ক্লাব বা রিয়ালিটি শো-র নামের আগে স্পনসর-নাম যেমন। একটাই খচখচ: অ্যাদ্দিন শোনা যেত ‘একটা মহানায়ক উত্তমকুমার দিন তো!’ এ বার তার জায়গায় ‘চারটে অমুক গুঁড়োমশলা মহানায়ক উত্তমকুমার দেবেন দাদা।’

অন্য বিষয়গুলি:

coronavirus Teachers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy