প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
রাজ্যে তেরো বছর, কেন্দ্রে দশ— তেইশ বছরের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় নরেন্দ্র মোদী এই প্রথম জোট সরকারের প্রধান হিসাবে শপথ নেওয়ার স্বাদ পেয়েছেন। কোনও রাজনীতিকের পক্ষেই বোধ করি এই স্বাদ রুচিকর নয়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তো নয়ই। বিশেষত, নীতীশ কুমার এবং চন্দ্রবাবু নায়ডুর মতো পরিপক্ব জোটসঙ্গীর মোকাবিলা করে শরিকি সরকার চালানোর পথে কত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে, সেই চিন্তা নিশ্চয়ই এখন তাঁর নিত্যসঙ্গী। তবে রবিবার সন্ধ্যার পরে প্রধানমন্ত্রী দাবি করতেই পারেন যে প্রথম পরীক্ষায় তিনি সসম্মান উত্তীর্ণ। পূর্ণমন্ত্রীর পদ না পেয়ে ক্ষুব্ধ এনসিপি-র প্রফুল্ল পটেল ঈষৎ বেসুর বাজিয়েছেন বটে, কিন্তু সামগ্রিক সাফল্যের ঐকতানে তা কার্যত হারিয়ে গিয়েছে। আপাতত ৭২ সদস্যের মন্ত্রিসভায় এগারোটি আসন পেয়েছে শরিক দলগুলি, ৩১ জন পূর্ণমন্ত্রীর মধ্যে পাঁচ জন তাদের সদস্য। অর্থাৎ, সংখ্যার বিচারে বিজেপি নিঃসংশয়ে প্রধান ও প্রবল।
প্রাধান্য এবং প্রাবল্যের অন্য অভিজ্ঞানগুলিও সুস্পষ্ট। প্রথমত, পূর্ণমন্ত্রীর আসনে বিজেপির আধিপত্য সঙ্কেত দেয়, গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলিও প্রধানত তাদের হাতেই থাকবে। দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে বর্তমান মন্ত্রিসভার ধারাবাহিকতা চোখে পড়ার মতো: শপথগ্রহণের পরে গৃহীত ও সম্প্রচারিত চিত্রাবলিই চেনামুখগুলিকে চিনিয়ে দেয়। এই পুনরাবৃত্তি আপাতদৃষ্টিতে ক্লান্তিকর ঠেকতে পারে, কিন্তু তা আবার নেতৃত্বের আত্মপ্রত্যয়ের বিজ্ঞাপনও বটে, হ্যাটট্রিক করে দিল্লির দরবারে ফিরে আসা প্রধানমন্ত্রী যেন তাঁর পরিচিত সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে জানাতে চান: অয়মহং ভোঃ। দ্বিতীয়ত, শিবরাজ সিংহ চৌহান এবং মনোহরলাল খট্টরের মতো পোড়-খাওয়া প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বা দলীয় সভাপতি জে পি নড্ডাকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রী কেবল অভিজ্ঞতার সম্পদ বাড়াতে চাইছেন না, সম্ভবত আপন সঙ্ঘশক্তিকে জোরদার করতেও উদ্যোগী হয়েছেন— এক দিকে শরিকদের সঙ্গে দরকষাকষিতে এবং অন্য দিকে সমৃদ্ধ ও পুনরুজ্জীবিত বিরোধী শিবিরের মোকাবিলায় বাড়তি শক্তি তাঁর পক্ষে এখন বিশেষ দরকারি।
কিন্তু গণতন্ত্রের অভিধানে শক্তির অর্থ কেবল আধিপত্য নয়। বিভিন্ন ও বিচিত্র অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয় বজায় রেখে সরকার চালানোর কুশলতাও গণতান্ত্রিক শক্তির বড় রকমের উৎস হতে পারে। এই সত্যটি এত দিন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থদের আধিপত্যবাদী চিন্তায় স্থান পায়নি। এ-বার কি ইতিহাস বদলাবে? চাপে পড়ে শরিকদের স্থান দেওয়ার বাইরেও বৈচিত্রকে গ্রহণ করার বৃহত্তর কোনও উদ্যোগ দেখা যাবে কি? এই শাসকদের হৃদয় পরিবর্তনের আশা বাতুলতামাত্র, কিন্তু অন্তত রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে তাঁরা কি কিছুটা জমি ছাড়বেন? তেমন কিছু লক্ষণ আছে। যেমন, কেরলে একটি আসনে জয়ী হয়ে সে রাজ্যের দু’জনকে মন্ত্রিপদ দেওয়া হয়েছে, এক জন খ্রিস্টান। তামিলনাড়ুতে খাতা খোলার স্বপ্ন ব্যর্থ হলেও মন্ত্রিসভায় সেই রাজ্য উপস্থিত। অন্য দিকে— হয়তো দলিতদের সমর্থনে বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার পরিণামে— চিরাগ পাসোয়ান-সহ বেশ কয়েক জন দলিত রাজনীতিক মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এ-সবই কার্যত পাদটীকার শামিল। সরকারে উত্তর ভারতের আধিপত্য এখনও প্রবল। এক ডজন আসনে শাসক দল জয়ী হওয়ার পরেও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের স্থান যৎসামান্য। এবং, অবশ্যই খেয়াল করা দরকার, মন্ত্রিসভায় মুসলিম সদস্যের সংখ্যা শূন্য! অর্থাৎ— সব কা সাথ সব কা বিকাশ নিছক একটি ‘জুমলা’— যথা পূর্বং তথা পরম্। প্রশ্ন হল, তিন নম্বর মোদী সরকারের কাজকর্মেও সেই পূর্বাপরতাই কি ক্রমশ প্রকট হবে? আপাতত, কিঞ্চিৎ নতুন পোশাকে সজ্জিত এই পুরনো মন্ত্রিসভা দেখে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি কথাই বলা চলে: ফলেন পরিচীয়তে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy