—ফাইল চিত্র।
অযোধ্যার নবনির্মিত রামমন্দিরে ২২ জানুয়ারি যে রাজসূয় যজ্ঞের সূচনা হয়েছিল, দিল্লির নবনির্মিত সংসদ ভবনে ১০ ফেব্রুয়ারি তার পূর্ণাহুতি সম্পন্ন হল। সপ্তদশ লোকসভার শেষ অধিবেশনের অন্তিম দিবসে সংসদে আলোচনার নির্ধারিত বিষয় ছিল: রামমন্দির। কেন এই বিষয় নির্ধারণ, সেই প্রশ্ন বাহুল্য। বর্তমান ভারতে মন্দির-কীর্তনই সংসদের সবচেয়ে গুরুতর কাজ বলে সাব্যস্ত হয়েছে। গুরুত্বের কারণ অবশ্যই ধর্ম নয়— রাজনীতি। অযোধ্যার মন্দির এবং তার বিগ্রহ সেই রাজনীতির প্রকরণ। তার ভরকেন্দ্রে বিরাজমান কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দলের সর্বাধিনায়ক। গণতন্ত্রের অভিধানে যে প্রধানমন্ত্রীকে ‘ফার্স্ট অ্যামাং ইকোয়ালস’ বা সমমর্যাদাসম্পন্ন অনেকের মধ্যে প্রথম বলে গণ্য করা হয়, তার মাপে এই নায়ককে সীমিত রাখার কথা ভাবলেও তাঁর ভক্ত ও অনুগামীদের রামায়ণ মহাভারত আদি সমস্ত ধর্মগ্রন্থ অশুদ্ধ হবে। সেই ধর্মে সবার উপরে তিনিই সত্য।
সংসদের দুই কক্ষেই শেষ দিনের কর্মকাণ্ডে এই সত্যটি ভীমনাদে ঘোষিত হয়েছে। শাসক দলের নায়কদের কণ্ঠে সে দিন যাঁর গুণকীর্তন সপ্তমে উঠেছিল তাঁর নাম, রামচন্দ্র নয়, নরেন্দ্র মোদী। মূল গায়কের ভূমিকায় ছিলেন রাজ্যসভায় বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা এবং লোকসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কেবল ব্যক্তিমাহাত্ম্যের কারণে নয়, বক্তব্যের মাত্রাতেও, দ্বিতীয় জনের ভাষণটি আক্ষরিক অর্থেই ঐতিহাসিক। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কণ্ঠে এই দিন যে অমিত উচ্ছ্বাসের স্রোত সহস্রধারায় নিঃসৃত হয়েছে, তার সারাৎসার: কেবল ভারতে নয়, সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে নরেন্দ্র মোদীর তুল্য কোনও মহাপুরুষ দেখা যায়নি। এগারো দিন ‘কেবল ডাবের জল পান করে’ তিনি রামমন্দিরের উদ্বোধনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, সাধুসন্তরা এমন কৃচ্ছ্রসাধন এবং ব্রতপালন করে থাকেন, কিন্তু এক জন প্রধানমন্ত্রী? ভাবা যায়?
বাস্তবিকই ভাবা যায় না। প্রধানমন্ত্রীকে কেন প্রধান পুরোহিতের কাজে নামতে হবে, গণতন্ত্রের স্বাভাবিক নিয়মে তার সদুত্তর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে বর্তমান শাসকদের দীর্ঘ ও পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্পের মধ্যে। বহুত্ববাদী গণতন্ত্রকে এক মত এক পথের আধিপত্যবাদী শাসনে পরিণত করে ব্যক্তিপূজার প্রকরণ নির্মাণের সেই প্রকল্প গত এক দশক যাবৎ উত্তরোত্তর প্রকট হয়েছে। তাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েই সংসদীয় গণতন্ত্রের সদর দফতরে দাঁড়িয়ে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যক্তিপূজার মন্ত্রপাঠ করেছেন এবং তাঁর সতীর্থমণ্ডলী ‘মোদী’ ‘মোদী’ ধ্বনিতে সঙ্গত করেছেন। এই প্রক্রিয়াতেই তাঁরা দেখাতে চেয়েছেন যে, প্রধানমন্ত্রীই রামরাজ্যের সৃষ্টিকর্তা এবং মহারাজাধিরাজ হিসাবে ভারতবাসীর কাছে স্বীকৃত। আসন্ন নির্বাচনী প্রচারের মরসুমে এই প্রচারকেই যদি তাঁরা নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে তৎপর হন, ‘জয় শ্রীরাম’ হুঙ্কার যদি অচিরেই ‘জয় শ্রীমোদী’ ধ্বনিতে একাকার হয়ে যায়, কিছুমাত্র বিস্ময়ের কারণ নেই। এই প্রচারকে ভারতবাসী কী ভাবে দেখছেন এবং দেখবেন, ব্যক্তিনায়কের মহিমায় আপ্লুত হয়ে ভক্তিরসে ভেসে যাবেন, না আত্মশক্তিতে সেই প্লাবনকে প্রতিরোধ করে গণতান্ত্রিক স্বাধিকার রক্ষা করতে তৎপর হবেন, তার উপরেই নির্ভর করছে দেশের সমাজ ও রাজনীতির গতিপথ। স্পষ্টতই, ভারতীয় গণতন্ত্র এই মুহূর্তে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথসন্ধিতে দাঁড়িয়ে। সপ্তদশ সংসদের শেষ লগ্নে শাসক শিবির তাদের অভীষ্ট পথটিকে নিঃসংশয়ে এবং বীরবিক্রমে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তৈরি অষ্টাদশ সংসদ সেই অভীষ্ট পূরণের প্রকরণ হয়ে উঠবে, না আধিপত্যবাদী ব্যক্তিতন্ত্রকে অস্বীকার করে যথার্থ গণতন্ত্রের সাধনায় ফিরতে চাইবে, তার উত্তর দেওয়ার কর্তব্য এবং অধিকার দুনিয়ার সর্বাপেক্ষা জনবহুল দেশটির নাগরিকদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy