সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
ইংরেজিতে একটি শব্দবন্ধ আছে, ‘ওয়ার্কেবল ট্রাস্ট’, যার জুতসই বাংলার অভাবে বলা যেতে পারে, কাজ-চালানোর মতো আস্থা। গণতন্ত্র সফল ভাবে চলার অন্যতম মৌলিক সূত্রই হল, শাসনবিভাগ, আইনবিভাগ ও বিচারবিভাগ এই তিন স্তম্ভের মধ্যে আস্থা ও পারস্পরিক সম্মান। সম্মান তো দূরস্থান, একটা কাজ-চালানো গোছের আস্থাও যে বর্তমান ভারতে শাসনবিভাগ ও বিচারবিভাগের মধ্যে থাকছে না, এটা একটা বিরাট সঙ্কটের দিকে ঠেলে নিয়ে এসেছে ভারতীয় গণতন্ত্রকে। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত আরও এক বার দেশের কেন্দ্রীয় সরকারকে মনে করিয়ে দিল, সরকারি কাজে এই ‘আস্থা’ কী ভাবে বিনষ্ট হচ্ছে সেটা দেখে যথাযোগ্য পদক্ষেপ করতে। প্রসঙ্গটি ছিল— সম্ভাব্য বিচারপতি মনোনয়ন বিষয়ক কলেজিয়ামের প্রস্তাব থেকে সরকারের ছেঁটেকেটে নাম গ্রহণ ও স্বীকৃতি। বার বার এমন ছাঁটকাট হতে হতে দুই বিভাগের সম্পর্ক ভীষণ রকম ক্ষতিগ্রস্ত হতে বসেছে। বিচারপতিদের নির্বাচন যদি কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনা দিয়েই করা হয়, সে ক্ষেত্রে তো দুই বিভাগের সম্পর্কই পাল্টাতে শুরু করবে, এই হল আশঙ্কা। এবং তার ফলে বিচারের নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন উঠবে, এমনকি সরকারের কাছেও তা সে ভাবেই প্রতিভাত হওয়ার আশঙ্কা। সরকারের যদি কোনও রায় অপছন্দসই হয়, বলার জায়গা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে যে, রাজনৈতিক মতামত দিয়ে সেই রায় প্রভাবিত হয়েছে। কোনও ভাবেই এমত পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণতন্ত্রের প্রধান ভিত হল বিচারবিভাগের নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক মতামত-ঊর্ধ্ব বিবেচনা। তাকে যদি কোনও রাজনীতি-মত গ্রাস করতে উদ্যত হয়, তা হলে তন্ত্রটিই যায় পাল্টে, বলা বাহুল্য।
মাননীয় বিচারপতি সঞ্জয় কিশন কউল-এর নেতৃত্বে যে বেঞ্চ বিষয়টির পর্যালোচনা করছে, কেন্দ্রের কাছে তার অনুরোধ যে, কেবল রাজনৈতিক অণুবীক্ষণ কিংবা ছিদ্রসন্ধানকেই কাজে না লাগাতে। কেননা, রাজ্যগুলির বাস্তব পরিস্থিতিতে কোনও না কোনও ভাবে আইনজীবীদের রাজনীতির সঙ্গে আদানপ্রদান থাকাই সম্ভব। কিন্তু সেটুকু দিয়েই কারও সমস্ত কাজকর্মের মূল্যায়ন হয় না। আদানপ্রদান মানেই আত্মবিক্রয় নয়। এ বিষয়ে আরও অনেক সংবেদনশীল ও বাস্তবানুগ হওয়া দরকার। ঘটনা হল, এই ভাবে মনোনয়ন করতে গিয়ে কলেজিয়ামে প্রস্তাবিত অনেক সিনিয়র আইনজীবী বাদ পড়ে যাচ্ছেন, জুনিয়র ও তুলনায় কম যোগ্যরা উপরে উঠে আসছেন, এবং তার থেকে তৈরি হচ্ছে ব্যাপক ক্ষোভ। গোটা ব্যবস্থার মধ্যে যদি এই পরিমাণ টানাপড়েন ও ক্ষোভবিক্ষোভ চলতে থাকে, তা হলে তাঁরাই বা কী করে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করবেন, আর মানুষের মনেই বা কী উপায়ে তাঁরা নিরপেক্ষ হিসাবে প্রতিবিম্বিত হবেন।
উল্টো দিকে, যদি সরকার থেকে কারও নাম বিচারক হিসাবে প্রস্তাবিত হয়, এবং কলেজিয়াম তা না মানে, সে ক্ষেত্রে সেখানেই বিষয়টির ইতি, এও দাবি করা হয়েছে। সঙ্গত দাবি। বিচারবিভাগের অংশ হয়ে যিনি ঢুকবেন, বিচারবিভাগের উচ্চ প্রতিনিধিরা যদি তাঁর প্রতি আস্থাশীল না হন, সে ক্ষেত্রে কাজ চালানোই কঠিন হতে পারে। সোজা কথায়, কলেজিয়াম সম্পর্কিত বিতর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে মানতে হবে যে, শাসনবিভাগের দিক থেকে বিচারবিভাগের ‘বিচারবিবেচনা’র প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর্তব্য। তার অর্থ যদি দাঁড়ায়, কখনও-কখনও সরকারকে পশ্চাদপসরণ করতে হবে, সেটাই বাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত, এই টানাপড়েন নতুন নয়, গত সাত দশকে ভারত বার বার এই ফাঁদে পড়েছে। কিন্তু মোদী সরকারের আমলে কলেজিয়াম সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব যে মাত্রায় পৌঁছেছে তা অ-ভূতপূর্ব। সরকার যতই সংখ্যাগরিষ্ঠের দাপটে নিজেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মনে করুক, বিচারবিভাগের মতো সর্বাধিক গুরুত্বময় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপর তার এমন ছড়ি ঘোরানো বন্ধ হোক। এখনই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy