পটনায় বিরোধী বৈঠক। ছবি: পিটিআই।
পটনায় ১৫টি রাজনৈতিক দল এক মঞ্চ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির নায়কনায়িকাদের যে ভাবে বিরোধী দলগুলির এই উদ্যোগকে তুচ্ছ এবং অবান্তর প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লাগতে দেখা গেল, তাতেই বোঝা যায় যে, এই উদ্যোগের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য তাঁরা টের পেয়েছেন। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের বাসভবনে সমবেত দলগুলির মধ্যে নানাবিধ টানাপড়েন অবশ্যই আছে, তাদের যথার্থ একজোট হওয়ার লক্ষ্য পূরণের কাজটি যে সহজ নয় সে-কথাও অনস্বীকার্য। কিন্তু পটনা বৈঠকের গুরুত্ব এখানেই যে, এমন একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবং সেই অনুষ্ঠানকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা চলবে না, কারণ সমন্বয়ের কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংসদের বাদল অধিবেশনের আগেই শিমলায় পরবর্তী বৈঠক আয়োজনের সিদ্ধান্ত স্থির হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সতীর্থরা বিপদসঙ্কেত চিনতে ভুল করেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দলীয় সভাপতি কালক্ষেপ না করে আসরে নেমেছেন। কেউ বলেছেন, পটনায় বিরোধীরা সমবেত আলোকচিত্র তোলাতে গিয়েছিলেন, কেউ আবার জরুরি অবস্থার রূপকার ইন্দিরা গান্ধীর নাতির সঙ্গে বৈঠক করার জন্য বিরোধীদের খোঁটা দিয়েছেন। কিন্তু এহ বাহ্য, আগে কহ আর— বাক্পটু মন্ত্রী ও দল-নায়িকা স্মৃতি ইরানি সকাল-সন্ধ্যা দু’বার সাংবাদিক বৈঠক করে বিরোধীদের উদ্দেশে তোপ দেগেছেন। তাঁদের সর্বাধিনায়ক বোধ করি সুদূর ওয়াশিংটনে বসে পটনার ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত হয়ে আপন মনে বলেছেন, “ভাল লাগছে না রে, তোপসে!”
বিরোধী ঐক্যের পথটি অবশ্যই কঠিন, সে-পথে খানাখন্দ বিস্তর, ল্যান্ডমাইনও সম্ভবত কম নেই। এই মুহূর্তে এক নম্বর সমস্যা কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টির দ্বন্দ্ব নিয়ে, যে দ্বন্দ্ব পটনায় রীতিমতো প্রকট হয়েছে, রাজ্য সরকারি আধিকারিকদের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জারি করা অধ্যাদেশের প্রশ্নে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আপ-এর লড়াইয়ে কংগ্রেস স্পষ্ট সমর্থন না জানালে অরবিন্দ কেজরীওয়াল বিরোধী-মঞ্চ থেকে সরে যাওয়ার সতর্কবাণী ঘোষণা করেছেন। সমস্যা আছে বিভিন্ন রাজ্যের রাজনীতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি-বিরোধী শিবিরের এক বা একাধিক দলের স্বার্থ-সংঘাত নিয়েও, যেমন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বা কেরলে সিপিআইএম। আবার দ্বন্দ্ব আছে অন্য দলগুলির কারও কারও নিজেদের মধ্যেও, যথা পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ও সিপিআইএম। স্পষ্টতই, এই সব ক্ষেত্রে রাজ্য রাজনীতির সঙ্গে সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্ক পুরোপুরি মিলতে পারে না। সুতরাং সমস্ত সংশ্লিষ্ট দলকেই জটিল বোঝাপড়ার পথ খুঁজতে হবে, পরস্পরের সঙ্গে প্রয়োজনীয় বোঝাপড়া করতে হবে, বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে। সদিচ্ছা যদি থাকে, রাস্তাই রাস্তা বলে দেবে। রাজনীতি নামক সম্ভাবনার শিল্পটি গড়ে তোলার কোনও পূর্বনির্ধারিত সূত্র নেই।
শাসক বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধী ঐক্যের প্রয়োজন স্বীকার করে না, করতে পারে না। তাদের বয়ানে বিরোধীদের ঐক্যপ্রয়াস কেবলমাত্র বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ‘নেতিবাচক’ উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়। কিন্তু সত্য এই যে, প্রায় এক দশকের শাসনে নরেন্দ্র মোদীর সরকার গণতান্ত্রিক আদর্শ ও কর্মপন্থার বিপুল ক্ষতি সাধন করেছে, যার ফলে গণতন্ত্রের ভিতটিই বিপন্ন হয়েছে। এই সঙ্কট থেকে গণতান্ত্রিক ভারতকে বাঁচানোই বিরোধী ঐক্যের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হওয়া বিধেয়। লক্ষণীয়, পটনায় সমাগত বিরোধী রাজনীতিকদের অনেকের কথাতেই এই উপলব্ধির পরিচয় মিলেছে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করার তাগিদ বিরোধী দলগুলিকে নিজেদের স্বার্থ-সংঘাতকে সরিয়ে রেখে একটি যথার্থ সংহতি প্রতিষ্ঠার বিচক্ষণতা ও সামর্থ্য দিতে পারবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy