জালিয়ানওয়ালা বাগের নূতন রূপটি দেখিয়া দেশবিদেশের প্রতিবাদীরা কেন ক্ষুব্ধ হইতেছেন, তাহা সম্ভবত রূপকারদের বুদ্ধির বাহিরে। ক্ষোভের কারণ বুঝিবার ক্ষমতা থাকিলে তাঁহারা এমন কাণ্ড ঘটাইতে পারিতেন না। এই অক্ষমতার একটি উৎস অবশ্যই ঐতিহাসিক। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সহিত, ঔপনিবেশিক প্রভুদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনচেতা ভারতবাসীর দীর্ঘ সংগ্রামের সহিত, বহু মানুষের আত্মবলিদানের ইতিহাসের সহিত বর্তমান শাসকদের কোনও আদর্শগত সংযোগ নাই। সঙ্ঘ পরিবারের ইতিহাস স্বাধীনতা আন্দোলন হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিবার অথবা সেই আন্দোলনের বিপরীতে থাকিয়া বিদেশি শাসকের প্রতি আনুগত্য দেখাইবার ইতিহাস, সুতরাং জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনার তাৎপর্য তাঁহাদের বোধগম্য হইবে না— এই সমালোচনাকে অযৌক্তিক বলিবার উপায় নাই। এই সংশয়ও অহেতুক নহে যে, ব্রিটিশ শাসকদের পৈশাচিক নির্দেশনায় নিরস্ত্র অসহায় ভারতবাসীদের হত্যাকাণ্ডের কাহিনিকে উপলক্ষ করিয়া বর্তমান শাসকরা নিজস্ব রাজনীতির বীজ বুনিতে আগ্রহী। নূতন স্মারক চত্বরের আনুষ্ঠানিক উন্মোচন করিয়া প্রধানমন্ত্রী যে বাণী প্রচার করিয়াছিলেন তাহাতে ১৯১৯ সালের সেই মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ ছিল, কিন্তু সেই সূত্রেই তিনি আবার ১৪ অগস্টকে ‘দেশভাগের বিভীষিকার স্মারক দিবস’ হিসাবে উদ্যাপনের কথা বলিতে ছাড়েন নাই। জালিয়ানওয়ালা বাগের কাহিনিও কি বিভাজনী রাজনীতির কাঁচামাল?
কিন্তু সেই কাহিনিকে স্মরণ করিতে গিয়া স্মারক চত্বর-এর যে ‘সংস্কার’ সাধিত হইয়াছে তাহা জানাইয়া দেয়, সংস্কারকদের অক্ষমতার স্বরূপটি আরও অনেক মৌলিক। কোন ইতিহাসের স্মরণে কী করিতে হয় এবং— আরও বড় কথা— কী করিতে হয় না, তাহার সুস্থ, স্বাভাবিক, সভ্যতার উপযোগী কোনও ধারণাই দৃশ্যত তাঁহাদের নাই। তাঁহারা আড়ম্বর এবং জাঁকজমককেই সম্মান জানাইবার একমাত্র প্রকরণ বলিয়া মনে করেন। তেমন প্রকরণ যে প্রকৃত বেদনার স্মারক হইতে পারে না, বরং জাঁকজমক ও আড়ম্বর সেই স্মৃতিকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে, এই বোধটিই সম্ভবত তাঁহাদের অজ্ঞাত। তাঁহারা জানেন না, কিছু কিছু স্মারকের অঙ্গে চড়া সাজসজ্জা মানায় না, তাহার নিরাভরণ এবং নিরাবরণ অস্তিত্বই সশ্রদ্ধ চেতনায় ট্র্যাজেডির সংবেদন জাগাইতে পারে, সংবেদী মানুষ তাহার সম্মুখে নতমস্তকে নীরব থাকিয়া আপন শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন, আত্মশুদ্ধির সাধন সংগ্রহ করিয়া লন। হিরোশিমা বা অউশভিৎজ়-এ সেই গভীর বেদনার পরিবেশ সযত্ন সংযমের সহিত সুরক্ষিত আছে। এই সংযম সভ্যতার সূচক।
জালিয়ানওয়ালা বাগের নূতন সংস্করণের স্রষ্টারা সেই সভ্যতার স্বাদ হইতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। সংযম তাঁহাদের স্বধর্ম নহে, অসংযমই মজ্জাগত। তাই তাঁহাদের পরিচালনায় মারণ-গলির দেওয়ালে লগ্ন হয় রকমারি ‘স্মারক মূর্তি’, সেই সঙ্কীর্ণ বিষাদ-সরণির উপরে নির্মিত আচ্ছাদন স্মৃতি-পথিকদের মাথার উপরে আকাশ ঢাকিয়া দেয়, মরণ-কূপকে আড়াল করে কাচের দেওয়াল, ‘আলোক এবং ধ্বনি’ দিয়া বেদনার্ত নীরবতাকে খানখান করিবার বন্দোবস্ত হয়, এবং মূল স্মারক ঘিরিয়া তৈয়ারি হয় কৃত্রিম সরোবর— অবশ্যই পদ্মফুলে শোভিত। কে বলিতে পারে, কালে কালে হয়তো ‘টয় ট্রেন’ও চলিবে। সভ্য ও শোভন রুচিবোধকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া যে কোনও উপলক্ষেই ‘ধামাকা’ সৃষ্টির এই নির্বোধ অসংযম দেখিয়া সুস্থমনে নাগরিক একটি কথাই বলিতে পারেন— ইহারা জানে না ইহারা কী করিতেছে। তবে কিনা, অশালীন কুরুচির এই উদ্যাপনে নরেন্দ্র মোদীরা বিরোধী শিবিরের এক সহমর্মীকেও পাইয়াছেন, তিনি পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহ। এমন সমঝদার লাভ করিয়া প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই আহ্লাদিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy