আম্বেডকরকে যদি একটিমাত্র বিশেষণে তুলে ধরতে হয়, হয়তো অগ্রাধিকার পাবে ‘বিতর্কিত’ শব্দটি। এ বারের শীতের সংসদে আম্বেডকর-কাণ্ড অনেক দিন পর অক্ষরে অক্ষরে তা মিলিয়ে দিল। বাস্তবিক, বাবাসাহেব আম্বেডকর এমনই এক জন রাজনৈতিক বা দার্শনিক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে নিয়ে বিতর্ক হাতাহাতি-মারপিটের পর্যায়ে চলে যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক তো কিছু নেই বটেই, এক দিক দিয়ে দেখলে ভারতের বিবিধ ভয়ঙ্কর বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকা এই মানুষটির ক্ষেত্রে সেটাই যেন সবচেয়ে ‘স্বাভাবিক’। যে ভারতে কেবলই আম্বেডকরের গুণগান হয়, এবং তাঁর অভিমুখে ভক্তিরসের বন্যা বইতে থাকে, সেই ভারতই বরং সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়, ভক্তিডালার পিছনে কিছু কালো আছে, প্রতারণা আছে, এমনই মনে হয়। বিশেষত যে ভারতীয় জনতা পার্টি সর্বার্থেই জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পার্শ্বগামী— তার শাসনে যখন আম্বেডকর-ভক্তির প্রবাহ বইতে থাকে, তখন সেই সন্দেহ ঘোর আতঙ্কে পরিণত হয়, প্রতারণা মিথ্যাচার হয়ে যায়। আবার, কংগ্রেসের দিক থেকেও আম্বেডকর-ভক্তি কিছুটা আতিশয্য-মাফিক, এবং রাজনীতির প্রয়োজনে আলঙ্কারিক, তাও বুঝতে অসুবিধা নেই। আম্বেডকরের নাম বার বার জপে কংগ্রেস ও বিরোধী নেতারা প্রতারণা করছেন— স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কথাটি যে ভাবে বলেছেন তা অত্যন্ত কুরুচিসম্পন্ন। তবে এতে কিছু সত্যাণু রয়েছে। নেহরু-নেতৃত্বে কংগ্রেসের সঙ্গে আম্বেডকরের একাধিক সংঘাতবিন্দু ছিল, আজ যে কথা আর তোলা হয় না। কিন্তু সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি আরও বড় সত্য স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল হওয়া দরকার। তা হল, কংগ্রেসের থেকে তাঁর অনেক বেশি, অনেক মৌলিক, অনেক ব্যাপক সংঘাত ছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে। ফলে বিজেপি এখন তাঁকে যে ভাবে ‘ব্যবহার’ করে, তার মধ্যে ইতিহাসের আরও বড় অন্যায় আছেই, দ্বিচারিতা ও মিথ্যাভাষণ আছে ভূরি ভূরি। অমিত শাহ এবং তাঁর দল প্রথমে নিজেদের দিকে আঙুল তুলুন, তার পর অন্য কারও কথা ভাববেন, বলবেন।
রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত আম্বেডকরকে কেন্দ্র করে এখন জটিল রূপ নিচ্ছে, হয়তো আরও নেবে। সেই রাজনীতির জটিল রাস্তা বিচার করার আগে স্পষ্ট একটা ইতিহাসের তথ্য চাই— জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে আম্বেডকরের রাস্তা চূড়ান্ত ভাবে আলাদা হয়ে গেল কখন এবং কেন। হিন্দু কোড বিল ছিল সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং আম্বেডকর দুই জনেই ছিলেন হিন্দু কোড বিল আনার পক্ষে। সেই সংস্কারের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের অন্তঃস্থিত নানা রকম বৈষম্য এবং অনাচারের নিরসন হতে পারে বলে তাঁরা ভাবছিলেন। যেমন, সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকারের সূত্রপাত, বহুবিবাহ রোধ, বিধবার পুনর্বিবাহে স্বীকৃতি, এক জাতের মধ্যে বিবাহের বাধ্যতা লোপ, এই সব কয়টি বিষয়ই সেই বিলে ছিল। আম্বেডকরের ভাষায়, হিন্দু সমাজের মূল সূত্রটা আছে শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির, জাতির সঙ্গে জাতির বিরোধ চালু রাখার মধ্যে, আর সেখানে যদি সংস্কার না আনা যায় তা হলে কোনও সাংবিধানিক অধিকারেরই কোনও অর্থ থাকে না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কী প্রবল বিরোধিতার সামনে পড়েছিল এই বিল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা খড়্গহস্ত হয়ে উঠেছিলেন এই বিলের বিরুদ্ধে। শেষ অবধি তুমুল চাপের সামনে প্রধানমন্ত্রী পিছু হটতে বাধ্য হন। তার প্রত্যক্ষ ফলাফল, আম্বেডকরের পদত্যাগ। নেহরু কেন পিছিয়ে এলেন? ১৯৫১ সালে প্রথম জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি তখন শুরু হচ্ছে, হয়তো তাই সময় নিয়েছিলেন তিনি। অর্থাৎ? নেহরু ও তাঁর কংগ্রেসের সঙ্গে আম্বেডকরের সেই সময়ের বিচ্ছেদটি ঘটিয়েছিলেন সনাতন-পন্থী হিন্দুত্ববাদী নেতারাই। নেহরু তাঁদের চাপে পশ্চাদপসরণ করেছিলেন। আম্বেডকর তা মানতে পারেননি।
এই ইতিহাস পিছনে লুকিয়ে বিজেপি নেতারা আজকের কংগ্রেসকে আম্বেডকর-বিরোধী বলে গাল দিলে তাতে কেবল অর্ধসত্য বলা হয় না, অন্যায়ের ভারা পূর্ণ হয় একশো শতাংশ। আম্বেডকরের আজীবন সংগ্রাম হিন্দু সমাজের সামাজিক বৈষম্য ও অনধিকারের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামে তিনি সে দিন ছিলেন প্রায় একাকী। ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষ ও বিরোধে পরিপূর্ণ এই উত্তরোত্তর হিন্দুত্ব-অভিমুখী ভারতে আজও তিনি ততটাই একাকী। কোনও রাজনীতিই তাঁকে আত্মসাৎ করতে না পারুক, এটাই কাম্য। তেমন রাজনীতি এখনও এই ভারত নির্মাণ করতে পারেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy