রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি-র প্রথম পত্রটির সূচনায় সমাজের সুযোগবঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবীর দুর্দশা সম্পর্কে একটি অসামান্য বাক্য আছে: “তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে— উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।” সঙ্গত কারণেই উক্তিটি সুবিদিত এবং বহুচর্চিত। উপরের আলো এবং নীচের অন্ধকার, তথা ন্যূনাংশিকের সমৃদ্ধি এবং বৃহদাংশিকের দারিদ্রের এই সহাবস্থানে যে বিপুল আর্থিক বৈষম্য, রবীন্দ্রনাথকে তাহা নিরন্তর তীব্র পীড়া দিত। তাঁহার বহু রচনায় এবং ভাষণে তাহার গভীর পরিচয় আছে। তাহার জন্য তাঁহাকে ‘সাম্যবাদী’ মতাদর্শের ধ্বজা ধরিতে হয় নাই, সম্পদ পুনর্বণ্টনের জবরদস্তিকে তিনি অনুমোদন করেন নাই, স্তালিন-শাসিত রাশিয়ায় আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য হ্রাসের প্রশংসা করিবার সঙ্গে সঙ্গে ‘জবরদস্ত লোকের একনায়কত্ব’ এবং তাহার অশুভ পরিণামের বিষয়ে অন্তর্ভেদী সমালোচনায় তিনি স্পষ্টবাক। কিন্তু অস্বাভাবিক বৈষম্যের অন্তর্নিহিত অন্যায়কে স্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করিতেও তাঁহার ভুল হয় নাই।
কোভিড অতিমারির কালে বৈষম্য যে চরম মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে, তাহার রূপ দেখিলে রবীন্দ্রনাথের লেখনীও হয়তো নির্বাক হইয়া যাইত। গত এক বৎসর বা তাহার কিছু অধিক সময় ধরিয়া বৈষম্য বৃদ্ধির নানাবিধ পরিসংখ্যান প্রকাশিত হইয়া চলিয়াছে। সম্প্রতি সেই ধারায় নূতন বিভীষিকা সংযোজন করিল অক্সফ্যাম নামক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নূতন সমীক্ষার রিপোর্ট। এই রিপোর্ট দেখাইতেছে যে, বিশ্ব জুড়িয়া আর্থিক বৈষম্যের মাত্রা বিপুল ভাবে বাড়িয়াছে, বাড়িয়াছে ভারতেও। মনে রাখা দরকার, সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে ভারতে বৈষম্যের মাত্রা রীতিমতো চড়া। তাহার উপর, অতিমারির অভিঘাতে দেশের অধিকাংশ নাগরিকের আয় এবং জীবনমানে যখন বড় রকমের অবনতি ঘটিয়াছে, সেই সময়পর্বেই স্ফীত হইয়াছে উপরতলার ঐশ্বর্যবানদের সম্পদ। অর্থাৎ পূর্বাবস্থাতেই বৈষম্য বিপুল ছিল, সঙ্কটকালে তাহা বিপুলতর— সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র দরিদ্রতর হইতেছেন, অনুপাতে নিতান্ত সংখ্যালঘু সম্পন্নরা সম্পন্নতর।
পূর্বাবস্থার কারণেই এই পরিণাম গভীর উদ্বেগের কারণ। দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আর্থিক অবস্থা যদি চলনসই হয়, তাহা হইলে উপরতলার বাড়তি সমৃদ্ধি তথা বৈষম্য লইয়া অতিরিক্ত চিন্তিত হইবার কারণ থাকে না, বরং কিছু দূর অবধি অসাম্য আর্থিক উৎসাহ ও উন্নতির অনুকূল হয়— পরিপূর্ণ সাম্য ভূভারতে কোথাও উন্নয়নের সহায়ক হয় নাই। কিন্তু ভারতের সমস্যা ইহাই যে, দেশের এক বিপুলসংখ্যক নাগরিক এখনও হতদরিদ্র। এই পরিস্থিতিতে যখন বৈষম্য বাড়ে, তখন অর্থনীতি ও সমাজের কাঠামোয় বড় রকমের অসঙ্গতি তৈয়ারি হয়। সেই অসঙ্গতি আয়বৃদ্ধিরও প্রতিকূল। ধনীদের আয়ের অনুপাতে ভোগব্যয়ের মাত্রা দরিদ্র বা মধ্যবিত্তের তুলনায় অনেক কম, বিশেষত সাধারণ ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্পন্নদের চাহিদা হইতে বহুলাংশে বঞ্চিত। তাহার ফলে, আয় ও সম্পদের বৈষম্য প্রথমত বাজারের চাহিদায় মন্দা ডাকিয়া আনে, দ্বিতীয়ত চাহিদার ভারসাম্য নষ্ট করে। চাহিদা-মন্দার কারণে নূতন বিনিয়োগও ব্যাহত হয়। ভারতে তাহাই ঘটিতেছে— এক দিকে পণ্যের বাজারে মন্দা; অন্য দিকে প্রভূত বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগে ভাটার টান। বৈষম্যের সমস্যাটিকে সচরাচর ন্যায় বা নৈতিকতার দৃষ্টিতে বিচার করা হয়, ‘বৈষম্য-অলক্ষ্মী’ বা ‘লক্ষ্মী বনাম কুবের’ ইত্যাদি উপমা টানিয়া পবিত্র সাম্যবাদী ক্রোধ প্রকাশে বামপন্থী আলোচকদের বিপুল উৎসাহ। কিন্তু দারিদ্রের মধ্যে বিপুল বৈষম্যের সমস্যাটিকে এই ব্যবহারিক দিক হইতে বিচার করা জরুরি। প্রদীপের আলোয় আপত্তির কারণ নাই, পিলসুজের দুর্গতি দূর করা দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy