ছয় বছর আগে গ্রামছাড়া হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই এখনও বগটুইয়ে নিজের ভিটেয় ফিরতে পারেননি। এই সংবাদটি সম্ভবত গ্রামের চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারত না, যদি না সেই গ্রামেই মার্চের একুশ তারিখে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডটি ঘটত। অভিজ্ঞজনেরা বলবেন, শুধু বগটুই নয়, বাংলার গ্রামেগঞ্জে খোঁজ নিলে এমন আরও অনেক ঘরছাড়ার সংবাদ মিলবে। কেন তাঁরা ঘর ছাড়তে বাধ্য হন, এবং কেন ঘরে ফিরতে পারেন না, সেই কারণটি সহজেই অনুমেয়— গ্রামে পদে পদে বিপদ। সেই বিপদের মূল উৎস শাসক দলাশ্রিত বাহুবলীরা। প্রবণতাটি শুধু এই জমানার, বললে অনৃতভাষণ হবে। বাম জমানাতেও এই একই ঘটনা ঘটত, বর্তমান জমানাতেও ঘটে। পশ্চিমবঙ্গের জলহাওয়ায় যে রাজনৈতিক হিংসা মিশে গিয়েছে, এ তারই অনিবার্য ফল। বগটুইয়েও অনেকেই ঘর ছেড়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী, কেউ নিহতদের আত্মীয়-পরিজন। তাঁদের ঘরে ফেরার কী হবে, সেই প্রশ্ন হাওয়ায় ভাসছে। নিহতদের পরিজনকে ঘরে ফেরাতে বহু বিলম্বে হলেও পুলিশ সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু, বাকিদের কী ব্যবস্থা হবে? রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তের ঘরছাড়ােদরই বা কী হবে?
সেই ব্যবস্থা করতে পারে একমাত্র পুলিশ-প্রশাসন। ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরার পথে বৃহত্তম বাধাটির নাম নিরাপত্তার অভাব। সেই নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ পুলিশের। রাজ্য পুলিশের ভাবগতিক দেখলে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, এই নিরাপত্তা প্রদানের কাজটি ভয়ঙ্কর রকম কঠিন— হয়তো অসম্ভবই। শাসক দলের স্থানীয় বাহুবলী নিষেধ করায় যারা ঘটনাস্থলে পৌঁছতেই পারে না, তারা সেই বাহুবলীদের করাল গ্রাস থেকে মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, এমন আশা করতে বঙ্গবাসীর ইদানীং আর সাহস হয় না। কিন্তু, এই কাজটি করা ভিন্ন উপায়ান্তর নেই। তার জন্য প্রথমত পুলিশবাহিনীকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে, তারা কোনও নেতার চাকরি করে না। এক জন আইসিকে বরখাস্ত করে, অথবা এক জন এসডিপিও-কে সরিয়ে দিয়ে এই পরিবর্তন হওয়ার নয়। পুলিশবাহিনীকে স্থানীয় আনুগত্যের ক্লায়েন্টেলিজ়মের বাইরে রাখতে হলে এই দুষ্টচক্রটিকে একেবারে গোড়া থেকে ভাঙতে হবে। দুর্জনের মতে, পুলিশকে হাতে রাখার প্রয়োজন এখন মূলত অবৈধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বাধাহীন ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কোথাও বালি পাচার, কোথাও কয়লা খাদান, কোথাও নির্মাণক্ষেত্রের সিন্ডিকেট— এবং, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সেই অনাচারের পথটিকে মসৃণ করতে পুলিশের প্রয়োজন পড়ে। আবার, পুলিশের বাম মুঠি ভরে রজত-কাঞ্চনের সংস্থানও হয় এই অবৈধ ক্ষেত্রগুলির দৌলতেই। কাজেই, পুলিশের স্থানীয় আনুগত্য ভাঙার জন্য এই অর্থনৈতিক চক্রগুলির মূলোচ্ছেদ করা প্রয়োজন। কিন্তু, তা ভিন্ন সাধনার বস্তু। আপাতত পুলিশের কর্তব্যে অবহেলা দেখলেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা বিধেয়। এবং, শুধু নিচুতলার পুলিশকর্মীদের উপর খাঁড়া ঝোলালে কাজের কাজ হবে না— ভীতিটি একেবারে সর্বোচ্চ স্তরে সঞ্চারিত হওয়া জরুরি।
কিন্তু, যে ভাবেই হোক, ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হবে; সাক্ষী বা বিপন্নদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। সংবিধান দেশের প্রতিটি নাগরিককে নিজের পছন্দের স্থানে বিনা বাধায়, নির্বিঘ্নে বসবাস করার অধিকার দিয়েছে। নাগরিকের সেই অধিকার রক্ষা করা রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের প্রাথমিকতম কর্তব্যের তালিকাভুক্ত। কোনও অজুহাতেই সেই কর্তব্য অস্বীকার করা চলে না। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে সাক্ষীদেরও নিরাপত্তা দেওয়া জরুরি। এবং, তার চেয়েও জরুরি রাজ্যের প্রতিটি মানুষকে আশ্বস্ত করা যে, অরাজকতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাজ্যে সরকারের, প্রশাসনের রয়েছে। এই ভরসাটুকুও যদি না থাকে, কোন সাহসে মানুষ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাবেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy