Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Loreto College

বৈষম্যের কারণ

এই রাজ্যেরই বহু প্রতিষ্ঠান ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য ভিন্ন অন্য বিবিধ বিষয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্যও ইংরেজির পরীক্ষা নিয়ে থাকে।

loreto college.

লোরেটো কলেজ। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩৩
Share: Save:

ভুল স্বীকার করা, ক্ষমাপ্রার্থনা, এবং সেই ভুল সংশোধন করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান— তিনটি কাজই করেছেন কলকাতার লোরেটো কলেজ কর্তৃপক্ষ। অতএব, ইংরেজি ব্যতীত অন্য কোনও ভারতীয় ভাষায় লেখাপড়া শিখেছে, এমন ছাত্রীদের এই কলেজে ভর্তির জন্য বিবেচনা করা হবে না, এ-হেন উদ্ধত এবং স্পষ্টতই বৈষম্যমূলক বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বিতর্ককে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়াই বিধেয়। কিন্তু, এই বিতর্কটি একাধিক বৃহত্তর প্রশ্নকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এল। কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি নিজেদের উৎকর্ষ বজায় রাখার জন্য ছাত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনও মাপকাঠি স্থির করতে পারে না? তা যে পারে, সে বিষয়ে সংশয় নেই। প্রতিষ্ঠানে আবেদন করার জন্য ‘কাট-অফ’ নম্বর অথবা ভর্তি পরীক্ষা, সবই এই মাপকাঠির বিভিন্ন রূপ। এই রাজ্যেরই বহু প্রতিষ্ঠান ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য ভিন্ন অন্য বিবিধ বিষয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্যও ইংরেজির পরীক্ষা নিয়ে থাকে। কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কতখানি তৈরি ছাত্রছাত্রী চায়, তা সেই প্রতিষ্ঠানের বিবেচ্য। কিন্তু, ইংরেজি ব্যতীত অন্য কোনও মাধ্যমে লেখাপড়া শিখেছে বলে তার আবেদন বিবেচনাই না করা প্রশ্নাতীত রকম অন্যায়। এ ক্ষেত্রে যে পূর্বানুমান— অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমে লেখাপড়া না শেখাই অযোগ্যতার যথেষ্ট প্রমাণ— তা বৈষম্যমূলক, অসংবেদনশীল এবং সেই কারণে, অনৈতিক।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, উচ্চশিক্ষার জন্য ইংরেজিতে আগেভাগেই দখল থাকা কতখানি জরুরি? এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতে এখনও মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ অতি সীমিত, এমনকি বাংলার মতো অতি সমৃদ্ধ ভাষাতেও। ফলে, প্রায় সব উন্নত মানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই পড়ানোর মাধ্যমটি ইংরেজি। সেই ভাষায় যথেষ্ট দড় না হলে ছাত্রছাত্রীরা কতখানি বিপন্ন বোধ করে, অনতিঅতীতেই কলকাতার একাধিক খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে তার উদাহরণ মিলেছে। কিন্তু, ইংরেজিতে সড়গড় নয়, এমন ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধ করে রাখা তার সমাধান নয়। প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই তাদের জন্য ইংরেজি ভাষার ‘রিমেডিয়াল ক্লাস’-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শুধু ইংরেজির ক্ষেত্রেই নয়, প্রয়োজনে পাঠ্য বিষয়গুলিরও বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায়, যেখানে ইংরেজির পাশাপাশি শিক্ষকরা বাংলাতেও বুঝিয়ে বলবেন। ইংরেজিতে দক্ষতা বা তার অভাব যে কোনও ছাত্রের মেধার মাপকাঠি নয়, এই কথাটি ভুলে গেলে চলবে না। নিষ্করুণ ভঙ্গিতে তাদের বাদ দেওয়া নয়, প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য হওয়া উচিত তাদের যথাসাধ্য সাহায্য করা। বাংলা মাধ্যম থেকে অভিজাত কলেজে পড়তে আসা বহু ছাত্রছাত্রীই ইংরেজি মাধ্যমের পড়ুয়া চলনবলনে ‘স্মার্ট’ সহপাঠীদের তাচ্ছিল্যের শিকার হয়ে থাকে। আজ বলে নয়, ঔপনিবেশিক সমাজে এই প্রবণতা আবহমান কালের। কিন্তু, তাদের অনেকের স্মৃতিতেই এমন শিক্ষক বা অধ্যক্ষরাও আছেন, যাঁরা দু’বাহু প্রসারিত করে আশ্রয় দিতেন তাদের, বিশেষ যত্নে পুষিয়ে দিতেন আগেকার খামতিটুকু। প্রকৃত শিক্ষকের এটাই ধর্ম। এই ধর্মপালনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য।

যদি কোনও প্রতিষ্ঠান সচেতন ভাবে এই দায়িত্বকে অস্বীকার করতে চায়, তা হলে এই সংশয়ও উঠবে যে, আপত্তিটা ঠিক কোথায়— ইংরেজি না-জানার ফলে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে ভাষাগত ব্যবহারিক সমস্যা তৈরি হওয়ায়, না কি অন্য কোনও সমাজ-অবস্থানমূলক প্রশ্নে? পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শিক্ষা-মানচিত্রের সঙ্গে পরিচয় আছে, এমন ব্যক্তিমাত্রেই জানবেন যে, শহরে তো বটেই, ইদানীং মফস্‌সলেও কার্যত অবস্থাপন্ন পরিবার সন্তানকে আর বাংলা মাধ্যম স্কুলে পাঠায় না। সরকারি বা সরকার-পোষিত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে পড়তে যায় মূলত দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা, যাদের মধ্যে অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ আসলে এই শ্রেণিগত পরিচয়ের গন্ডি ধরে লক্ষ্মণরেখা টেনে দেওয়া নয়তো? আশঙ্কাটিকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। গত দশ বছরে ভারত শিক্ষার অধিকার আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখেছে— আইনের পাতায় যা-ই লেখা হোক না কেন, অভিজাত স্কুলের দরজা দরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত মানুষের সন্তানের জন্য ফাঁক হয়নি। সামাজিক চলমানতা সৃষ্টি করতে শিক্ষার গুরুত্ব নির্বিকল্প। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তারা যদি সেই সত্যটি না বোঝেন, তা হলে ‘শিক্ষা’ শব্দটিই তার তাৎপর্য হারায়।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE