দেশের বেহাল কর্মসংস্থানের হাল ফেরাতে গত বাজেটে এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ স্কিম (ইএলআই) বা কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত প্রণোদনা প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু গত অর্থবর্ষের শেষে তা ‘ফাঁকা আওয়াজ’ হিসাবেই থেকে গেল। ফেব্রুয়ারিতে শ্রম মন্ত্রক শ্রমবিষয়ক স্থায়ী কমিটিকে জানাল যে, চূড়ান্ত খসড়াটি তখনও সংসদীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের জন্য পাঠাতে পারেনি তারা। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ ১০,০০০ কোটি টাকাও সরকারকে ফেরত দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ঘোষণার পরের দু’বছরে দেশে দু’কোটি চাকরি তৈরির সরকারি খোয়াবনামাটির অপমৃত্যু ঘটল।
এর আগেও সরকার ‘স্কিল ইন্ডিয়া মিশন’-এর মতো প্রকল্প চালু করলেও এ-যাবৎ তা দেশের কর্মসংস্থানের ঘাটতি মেটাতে সক্ষম হয়নি। কেউ বলতেই পারেন যে, এ ক্ষেত্রেও ফল ভিন্ন হবে না— কারণ এই প্রকল্পটি মূলত আর্থিক সহায়তা বরাদ্দের উপরে জোর দিলেও, যে সীমবদ্ধতাগুলি কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং কর্মশক্তি বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, সেগুলিকে শনাক্ত করা এবং তার সমাধানের বিষয়টিকে অবহেলা করে এসেছে। যেমন, কাজের দক্ষতার ব্যবধান, ব্যবসায় প্রয়োজনীয় পুঁজি পেতে অসুবিধা কিংবা সরকারি নিয়মের বেড়াজালের মতো সমস্যার মোকাবিলা করার কোনও প্রত্যক্ষ অস্ত্র প্রকল্পগুলির অন্তর্গত নয়। তা ছাড়া, যাঁদের এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, ইএলআই-এর নীতিগুলি তাঁদের ক্ষেত্রে কার্যকর না হওয়ারই সম্ভাবনা প্রবল। বরং এ ক্ষেত্রে সম্পদের অপব্যবহারের আশঙ্কাই বেশি। যেমন, সরকার যদি কর্মীর মাইনের একটা বড় অংশ দিয়ে দেয়, তাতে কর্মীদের চেয়েও অনেক বেশি লাভ হবে সংস্থাগুলির। কর্মী নিয়োগের সময় যে কোনও সংস্থাই বাজার থেকে কম বেতনে কর্মী পাওয়ার চেষ্টা করে। বেতনের মধ্যে যদি সরকারই ১৫,০০০ টাকা দিয়ে দেয়, তবে সংস্থাগুলি চেষ্টা করবে ওই টাকার অঙ্ক কম দেওয়ার। অনুমান করা চলে এই টাকা শেষ পর্যন্ত সংস্থাগুলির জন্য পরোক্ষ ভর্তুকি হয়ে দাঁড়াবে, তাদেরই লাভের পরিমাণ বাড়াবে। তা ছাড়া স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনার উপরে জোর দেশের কর্মসংস্থানের পরিসরে স্থায়ী পরিবর্তন না-ও আনতে পারে। ভুললে চলবে না, বাজারে চাহিদা থাকলে, হাতে পর্যাপ্ত পুঁজি থাকলে তবেই কর্মী নিয়োগে উদ্যোগী হবে সংস্থাগুলি। কিন্তু এ-যাবৎ ভারতের বাজারের যা হাল, তাতে অধিকাংশ সংস্থারই অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন হবে না বলেই অনুমান। এই আশঙ্কাগুলি প্রকল্পের প্রথম দিন থেকেই ছিল— তার মধ্যে শ্রম মন্ত্রকের প্রকল্পের টাকা ফেরত প্রকল্পগুলির মুখ থুবড়ে পড়ার পথ আরও প্রশস্ত করে দিল।
দক্ষতার ঘাটতি পূরণ এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে হলে আরও বেশি সুসংহত পদক্ষেপের প্রয়োজন। এমন পদক্ষেপ, যেখানে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ পাবেন তরুণ-তরুণীরা, বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ থাকবে এবং সরকারি উদ্যোগগুলি বেসরকারি ক্ষেত্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তৈরি হবে। সমস্যা হল, প্রকৃত কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানসূত্র সচরাচর চটকদার হয় না— ফলে, তাতে তাৎক্ষণিক চমক নেই। এখন সরকারের মূল লক্ষ্য যে-হেতু দলের ভোট জোগাড় করাতেই সীমাবদ্ধ, তাই প্রকৃত সমাধানে তাদের রুচি হবে বলে আশা করা কঠিন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)