কাশ্মীরে গত চার বছরে সাধারণ মানুষ কঠিন বন্ধনে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছেন। —ফাইল চিত্র।
সাধারণত স্মৃতি বস্তুটি বেশ পিচ্ছিল, সমাজের সামূহিক স্মৃতি তো আরও বেশি। প্রচারমাধ্যম তাকে যতটুকু জিইয়ে রাখে, মনে করিয়ে দেয়, সেটুকু ছাড়া বাকি সবই বিস্মৃতিসাগরে গ্রস্ত ও নষ্ট হয়। স্বভাবতই জনমানসের এই বিস্মৃতিপরায়ণতা রাজনীতির একটি বিরাট সহায়িকা শক্তি। বিস্মৃতির উপর ভরসা করেই রাজনীতির ভাষ্য তৈরি হয়, এবং সেই ভাষ্য সাধারণ মানুষ অকাতরে গ্রহণ করে, লালন ও পালন করে। এই যেমন, তিনশো সত্তর ধারা বিলোপের চার বছরের মধ্যে কাশ্মীরে আর কী কী ঘটেছে, সেগুলি সাধারণত রাজনীতির প্রচার ও চর্চার মাধ্যমটিতে ধরা পড়ে না। অথচ সে সব মনে রাখা গেলে বুঝতে অসুবিধা হত না যে ৩৭০ ধারা বিলোপ আসলে কোনও একক পদক্ষেপ নয়, এর সম্পূর্ণ অর্থটি আসলে অনেক বড়, এবং সযত্ন পরিকল্পিত। ওই ঐতিহাসিক সংস্কারের এক বছরের মধ্যে, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে জম্মু ও কাশ্মীরে অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাক্ট প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্ত সরকারি তথ্য দেবনাগরী হরফে লিখিত হয়েছিল। মহারাজা হরি সিংহের জন্মদিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। মহারাজার বাহিনীর হাতে ১৯৩১ সালে যে বাইশ জন কাশ্মীরি বিদ্রোহীর প্রাণ গিয়েছিল, তাঁদের স্মরণে ১৩ জুলাই এত দিন শহিদ দিবস পালিত হত: সেই প্রথা বন্ধ করা হয়েছিল। প্রতিটি সংস্কারেরই মূল লক্ষ্য কাশ্মীরি মুসলমানদের গুরুত্ব হ্রাস করা। লক্ষণীয়, সে রাজ্যে ‘ডিলিমিটেশন’ বা ভোট-অঞ্চল নবনির্ধারণের বন্দোবস্ত হয় ৩৭০ ধারা বিলোপের সঙ্গেই। ডিলিমিটেশন কমিশনের প্রস্তাবে জম্মুতে ছ’টি আসন বর্ধিত হওয়ার কথা, কাশ্মীরে একটি— যার ফলে রাজ্যের মোট ৯০টি আসনের মধ্যে কাশ্মীরের গুরুত্ব কমা ও জম্মুর গুরুত্ব বাড়ার কথা। সে রাজ্যে মুসলমান ও হিন্দু জনসংখ্যার বিন্যাস মনে রাখলে এই সংস্কারের মূল লক্ষ্যটি স্পষ্ট।
এ-ও খেয়াল রাখা ভাল, নতুন করে সীমা নির্ধারণের এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সে রাজ্য থেকে মামলা ওঠায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত কয়েক মাস আগে সরকারি কমিটির প্রস্তাবকেই সমর্থন জানিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এ-ও বলেছে যে, আইনগত ভাবে এর প্রয়োগে কোনও অসুবিধা নেই। একটি প্রশ্ন এখানে উঠবেই: আইন এবং নৈতিকতা দু’টি কি একই বিষয়? আইনগত ভাবে সিদ্ধ হওয়াই কি গণতান্ত্রিক নৈতিকতার একমাত্র শর্ত? ২০২৬ সালের আগে জনগণনা হবে না, তা হলে কেন এই সংস্কার এখন জম্মু ও কাশ্মীরে প্রয়োগের কথা উঠছে? সুপ্রিম কোর্টের মত, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য বা প্রদেশ নয়, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। সেখানে এটা হতেই পারে। অবশ্যই আইনের দিক দিয়ে তা ‘হতেই পারে’। কিন্তু আদালতের উপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও সংশয় উত্থাপন জরুরি যে, এত তাড়াহুড়ো করে এমন একটি ঘটনা ঘটানো ‘আইনত’ ঠিক হলেও নৈতিক ভাবে সঙ্গত কি না— বিশেষত এমন একটি অঞ্চলে যে রাজ্য বা প্রদেশকে কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, অনালোচিত, একপাক্ষিক হস্তক্ষেপ করে বিপুল সংখ্যক অতিরিক্ত সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে, রাতারাতি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করে? এটাই কি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অনুযায়ী সিদ্ধ, কিংবা বাঞ্ছিত, কিংবা গ্রহণীয়?
কাশ্মীরে গত চার বছরে সাধারণ মানুষ যে কঠিন বন্ধনে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছেন, ইন্টারনেট সংযোগ থেকে স্কুলকলেজের স্বাভাবিক জীবন যেখানে নিয়মিত ভাবে ব্যাহত হয়েছে, বার বার অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে সব কানাকড়িও গুরুত্বের যোগ্য মনে করেননি। বরং তাঁরা ক্রমাগত বলে গিয়েছেন, কাশ্মীরের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’। স্বভাব শব্দটি অত্যন্ত জটিল। যা কাল অভাবনীয়, আজ তাকে বাস্তব করে দিলে সেটাই স্ব-ভাব হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তাই এমন দাবি করার আগে, কাশ্মীরের স্ব-ভাব ঠিক কী ও কেমন, কোনটা তার প্রকৃত স্বরূপ, এটাই নাহয় ভাবা হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy