ফাইল চিত্র।
নোবেলজয়ী অর্থশাস্ত্রী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি স্মরণ করাইয়া দিলেন, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নে ভারত লাভবান হইয়াছে ঠিকই, কিন্তু গরিব মানুষের উপর যাহাতে তাহার কুফল না পড়ে, তাহার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা করা হয় নাই। ২০২০ সালের তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করিবার পর এই কথাটির সহিত কেহ ভিন্নমত হইবেন বলিয়া সন্দেহ হয় না। কথাটি শুধু বিশ্বায়নের নহে— কথাটি পুঁজির সহিত সমাজের সম্পর্কের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। উদার বাণিজ্য প্রয়োজন, বাজারের স্বাধীনতা প্রয়োজন, তাহাতে সন্দেহ নাই— বিশ্বায়নকেন্দ্রিক বাণিজ্যের ফলে গোটা দুনিয়ায় আর্থিক সম্পদের পরিমাণ বহু গুণ বাড়িয়াছে। শুধু অর্থনৈতিক সংস্কারোত্তর ভারতের উদাহরণ হইতেই সেই সমৃদ্ধির আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। প্রশ্ন সেই সম্পদের বণ্টন লইয়া। টমাস পিকেটি তাঁহার গবেষণায় দেখাইয়াছেন, সমগ্র বিশ্ব এক অভূতপূর্ব আর্থিক বৈষম্য প্রত্যক্ষ করিতেছে— এবং, সেই ঘটনাটি ঘটিতেছে বিশ্বায়নের মধ্যাহ্নে। অর্থাৎ, পুঁজি যাহা উৎপাদন করিতে সক্ষম হইয়াছে, রাষ্ট্রব্যবস্থা তাহাকে বণ্টন করিয়া উঠিতে পারে নাই। তাহারই ফলে যে কোনও ধাক্কায় দরিদ্র মানুষের জীবন একেবারে বিপর্যস্ত হইয়া যায়। সরকার হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করিলে সেই মানুষদের পক্ষে এক দিনও শহরে টিকিয়া থাকা অসম্ভব হয়— তাঁহারা এমনকি পায়ে হাঁটিয়াও হাজার মাইল পাড়ি দিয়া ঘরে ফিরিতে চাহেন।
গরিবের জন্য বিপদ অনেক। অতিমারি তাহার একটি রূপ। রোগে আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা যদি ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমানও হয়, সেই ধাক্কা সামলাইবার ক্ষমতা সমান নহে। গরিবের চিকিৎসা না জুটিবার সম্ভাবনা বেশি। কাজ করিতে না পারিলে আয় শূন্য, ফলে সংসারও অচল। আবার, বিশ্বায়ন-বাহিত আর্থিক মন্দাও দরিদ্রকেই সর্বাগ্রে কাবু করে। গোড়ায় তাঁহারাই কাজ হারান— আবার, স্বল্প আয়ের দরুন সঞ্চয়ের পরিমাণ যৎসামান্য হইবার ফলে কর্মহীনতার ধাক্কা সামলানোও তাঁহাদের পক্ষে কঠিন হয়। বিশ্ব উষ্ণায়নজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের আঁচও সর্বাগ্রে লাগে দরিদ্র মানুষেরই গায়ে। তাহার পিছনেও বাণিজ্যের মস্ত ভূমিকা। ধনতন্ত্রের চাকা যত গতিশীল হইয়াছে, ততই লাভবান হইয়াছে ধনী রাষ্ট্রগুলি, এবং দরিদ্র রাষ্ট্রের ধনী জনগোষ্ঠী। কিন্তু, তাহার জন্য প্রকৃতিকে যে মূল্য চুকাইতে হইয়াছে, তাহার ফল ভুগিয়াছেন মূলত দরিদ্র মানুষ। অভিজিৎবাবুর বক্তব্যের সূত্র ধরিয়া বলা যায় যে, যত ক্ষণ না বিশ্বায়ন ও ধনতন্ত্র এই মানুষগুলির দায়িত্ব স্বীকার করিতেছে, তত ক্ষণ অবধি তাহা সম্পূর্ণ হইতে পারে না।
এই সঙ্কটের একমাত্র উত্তর দায়িত্বশীল ধনতন্ত্র— যাহা কেবল এই মুহূর্তের মুনাফা অর্জনে সন্তুষ্ট নহে, অর্থনীতির সমৃদ্ধিকে প্রসারিত করিয়া যে ধনতন্ত্র আপনাকে সুস্থায়ী করিয়া তুলিবার চেষ্টা করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপন্নতা যদি বাড়িতেই থাকে, তবে তাহা কাহারও পক্ষেই সুসংবাদ নহে। পুঁজির পক্ষেও নহে। কারণ, বাজারকে চলমান রাখিতে হইলে অধিকতর মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা থাকিতেই হইবে। মনে রাখা দরকার, সুস্থায়ী উন্নয়নের সহিত পুঁজি বা বিশ্বায়নের কোনও বিরোধ নাই। পুঁজিকে সেই সুস্থায়ী উন্নয়নে উৎসাহিত করিয়া তুলিবার কাজে রাষ্ট্রকে আপন ভূমিকা পালন করিতে হইবে। ভারতের মতো দেশে দাঁড়াইয়া এইখানেই শঙ্কিত হইতে হয়। এ দেশে রাষ্ট্র যে ভাবে সাঙাততন্ত্রের যুক্তিতে চালিত হয়, এবং সাঙাততন্ত্র তাহার স্বভাবধর্ম অনুসারে পুঁজিবাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য বিষয়ে যে রকম উদাসীন, তাহাতে রাষ্ট্র কি এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হইবে? সেই দূরদৃষ্টি কি এই রাষ্ট্রের আছে? তাহার কোনও লক্ষণ অন্তত আজ অবধি দেখা যায় নাই। ফলত, অর্থনীতিবিদরা ক্রমাগত কেবল অরণ্যে রোদন করিয়া আসিতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy