বেনিতো মুসোলিনি। ছবি: সংগৃহীত।
আরও একটি শতবর্ষ এসে গেল। একশো বছর আগে ১৯২২ সালের ঠিক এই সময়েই ইটালিতে বেনিতো মুসোলিনি ক্ষমতাশীর্ষের অভিমুখে যাত্রা করেন। সেই বছরের ৩১ অক্টোবরটি ছিল বহুশ্রুত ‘মার্চ অন রোম’-এর দিন, রাজধানী রোমের দিকে সেনাবাহিনী নিয়ে সেনাপতি মুসোলিনির অভিযান— যার অব্যবহিত পর রাজা তৃতীয় ভিক্তর এমানুয়েল তেত্রিশ বছর বয়সি মুসোলিনিকে ইটালির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করতে বাধ্য হন। ঠিকই, আরও ছাব্বিশ মাস পর ১৯২৫ সালের জানুয়ারিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতার পর তাঁর ক্ষমতাভিত দৃঢ় ভাবে প্রোথিত হয়। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তিনি সে সময়ে প্রতিষ্ঠা করেন, নিজেই গর্ব করে তাকে বর্ণনা করেন ‘টোটালিটারিয়ান স্টেট’ নামে। তবে মুসোলিনি নিজেই বলতেন যে, তাঁর শাসনকালের প্রকৃত জন্মদিনটি হচ্ছে ২৮ অক্টোবর— ১৯২২ সালে যে দিনটিতে তিনি ‘মার্চ অন রোম’-এর সূচনা করেছিলেন। ১৯২৫ সালে এই দিনটিতেই ‘ফ্যাসিস্ট রেভোলিউশন’-এর তৃতীয় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠিত হয় খুব ঘটা করে, এবং পরবর্তী কালে নিয়মিত ভাবে দিনটিকে পালন করা হয়। কুড়ি বছর একটানা ক্ষমতাসীন থাকেন এই ইটালীয় একনায়ক। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুচে অর্থাৎ মুসোলিনি গ্রেফতার হন রাজার নেতৃত্বে গ্র্যান্ড কাউন্সিলের ক্ষিপ্র সিদ্ধান্তে। এ আজ নতুন করে বলার নয় যে, এই দু’টি দশক কেবল ইটালির ইতিহাসে নয়, সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার মতো— কত দ্রুত, অতি দ্রুত, সাধারণ মানুষের সকল অধিকার বিনাশ করে তাকে রাষ্ট্রের পুতুল বানিয়ে সব দিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় ফ্যাসিস্ট ইটালিতে। সেই থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও শেষ অবধি কালান্তক বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত তা এই গ্রহবাসীকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
সেনাবাহিনী নিয়ে মার্চ করে রোম শহরে পৌঁছনোর এই ঘটনার পর থেকেই মুসোলিনির মুখ ইটালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার প্রথাটিও শুরু হয়। এক জন নেতার সর্বময় কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার বাধ্যতা, এবং তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকারের আবশ্যকতা যে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল, পরবর্তী কালে নাৎসি জার্মানি তার উত্তরাধিকার বহন করে। বাস্তবিক, ইল দুচে বা মুসোলিনির মুখমণ্ডল কিংবা সমস্ত শরীর-অবয়বের এই ক্রমাগত প্রদর্শন ও স্মরণের সংস্কৃতি ফ্যাসিস্ট ইটালির একটি বিশিষ্ট অবদান। আধুনিক সময়েও বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী নেতারা মুসোলিনির পদ্ধতিগুলি সযত্নে অনুসরণ করেছেন। সাফল্যও পেয়েছেন।
ইতিহাস যদি শুধুমাত্র পাঠ্যবইতেই আবদ্ধ থাকত, সম্ভবত ইতিহাস নিয়ে তা হলে এতটা ভাবতে হত না। মুশকিল এই যে, ইতিহাসকে কেবল অতীত রূপে দেখলে ভুল হবে— সে কেবলই নিজেকে ফিরিয়ে আনে, কখনও ট্র্যাজেডি হিসাবে, কখনও প্রহসন হিসাবে, কখনও বা বিভীষিকা হিসাবে। সুতরাং ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে কিছু শেখার চেষ্টার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। আজ পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে যেমন সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের তুফান, তেমনই কর্তৃত্ববাদেরও পুনরাগমনের পদধ্বনি। তাই, গত মাসের শেষে ইটালির প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতালাভের সংবাদে উৎফুল্ল হওয়ার আগেই আশঙ্কিত হয়ে স্মরণ করতে হয় যে, এই নতুন নেত্রী পুরোদস্তুর টোটালিটারিয়ানিজ়ম-এর সুতোয় নিজের রাজনীতির বার্তা গাঁথেন। সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে সে দেশে মুসোলিনির সবচেয়ে বড় সমর্থক তিনি এবং তাঁর দল ব্রাদার্স অব ইটালি, যাদের অন্যতম শীর্ষনেতার স্পষ্ট মন্তব্য: ‘আমরা সবাই ইল দুচে-র উত্তরাধিকারী’। মুসোলিনির এই তথাকথিত ‘উত্তরাধিকার’ কী ভাবে ইটালির জনজীবনকে প্রভাবিত করবে, তা এখনও দেখার। তবে বিশ্বের অন্যত্র বহু দেশে যখন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সঙ্কীর্ণ অসহিষ্ণু দমনযন্ত্র দিয়ে বহু মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলা হচ্ছে, সংখ্যালঘু, প্রান্তিক ও গোষ্ঠীগুলির কাছে রাষ্ট্র প্রাত্যহিক ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, প্রায় প্রতিবাদহীন ভাবে এই রাষ্ট্রসন্ত্রাস ক্রমাগত বেড়ে চলেছে— তা বিংশ শতকের ফ্যাসিতন্ত্রের স্মৃতি উস্কে দেয়। কেবল গালগল্প ও তর্কবিতর্কের উৎস হিসাবে ইতিহাসকে না দেখে, মানবসভ্যতার ভয়ঙ্কর সঙ্কট কী ভাবে অন্ধকারের অতলে টেনে নিয়ে যায়, তার সতর্কবার্তা রূপে ইতিহাস আলোচনা জরুরি। মুসোলিনিরাজের শতবর্ষে আর এক বার সেই বার্তা সজোরে ধ্বনিত হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy