তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল হিসাবে বিজেপি ঘোষণা করতেই পারে: তারা সর্বত্র সফল। ফাইল ছবি।
বরাবর বিজয়ীরাই ইতিহাস লেখে। সুতরাং ত্রিপুরা নাগাল্যান্ড মেঘালয়ের রাজনৈতিক বাস্তব যত বিভিন্নই হোক এবং নির্বাচনী ফলাফলের যথার্থ বিশ্লেষণে সেই বিভিন্নতার যত গুরুত্বই থাকুক, উত্তর-পূর্ব ভারতের এই তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল হিসাবে বিজেপি ঘোষণা করতেই পারে: তারা সর্বত্র সফল। বিশেষত, ত্রিপুরায় নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে গদিতে ফেরার নিশ্চিতি তাদের ছিল না। অনিশ্চয়তার একাধিক কারণ ছিল। এক, পাঁচ বছরের (অপ)শাসনে রাজ্যবাসীর মনে জমে ওঠা বিস্তর অসন্তোষ— ‘অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি’ ছিল রীতিমতো প্রবল। মাঝপথে মুখ্যমন্ত্রী পাল্টে এই সমস্যার মোকাবিলায় ‘গুজরাত মডেল’ প্রয়োগ করেছিলেন দলের নেতৃত্ব, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী। সেই কৌশল আবারও চরিতার্থ। দুই, সিপিআইএম এবং কংগ্রেসের জোটবদ্ধ লড়াই স্বভাবতই শাসক দলের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল। ভোটের অঙ্কে দৃশ্যত এই জোটের প্রভাব পড়েছে, কিন্তু তাতে দাঁড়িপাল্লার ঝোঁক বদলায়নি। তিন, মাত্র দু’বছর বয়সি তিপ্রা মথা নামক দলটি জনজাতি ভোটের ভারসাম্যে কতটা ব্যাঘাত ঘটাবে এবং তাতে বিজেপির লাভ-লোকসানের অঙ্ক কেমন দাঁড়াবে, তা নিয়ে স্পষ্ট পূর্বাভাস কারও কাছেই ছিল না। শেষ অবধি, অন্তত আপাতবিচারে, লোকসানের বদলে লাভই হয়েছে। এই নির্বাচন দেখিয়ে দিল, ত্রিপুরার রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটেছে এবং ঘটছে, কিন্তু বিজেপির গদি অটুট। আপাতত।
অতঃপর ত্রিপুরার রাজনীতি কোন পথে যাবে? ১৩টি আসনে জয়ী তিপ্রা মথা জানিয়েছে, তারা বিধানসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে বিরোধীর ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু সিপিআইএম (১১টি আসন) এবং কংগ্রেস (৩টি)-এর বিরোধী জোট থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে। এই অবস্থান অপ্রত্যাশিত ছিল না, কারণ ভোটের উদ্যোগপর্বে কংগ্রেস-সিপিআইএম জোট তাদের দাবিদাওয়া যথাসম্ভব মেনে নেওয়া সত্ত্বেও এই দল জোটের শরিক হওয়ার আমন্ত্রণ তথা আবেদনে সাড়া দেয়নি। নিজেদের ঝুলিতে জনজাতি ভোট এককাট্টা করাই তাদের স্পষ্ট লক্ষ্য। অনুমান করা চলে, সেই লক্ষ্যে অনেকখানি সফল হওয়ার সুবাদে তিপ্রা মথা অতঃপর রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয় স্তরের বিজেপি শাসকের সঙ্গে দর-কষাকষির মাত্রা বাড়াবে। ‘টিপ্রাল্যান্ড’ সেই দর-কষাকষির একটি প্রকরণ, কিন্তু একমাত্র প্রকরণ নয়। জনজাতি মানুষের দাবি ও বঞ্চনাবোধকে কেন্দ্র করে রাজনীতির এই টানাপড়েনের গতি ও প্রকৃতি কেমন দাঁড়ায়, সেটা কেবল ত্রিপুরার পরিসরেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার প্রাসঙ্গিকতা আছে অন্য নানা রাজ্যের ক্ষেত্রে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষত উত্তরবঙ্গের মতো অঞ্চলগুলিতে।
কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা জোট বাঁধার যথেষ্ট সুফল কেন পায়নি সেই বিষয়ে দুই শিবিরের নেতারাই ‘বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে’ নামক ক্লান্ত বাঁশির পরিচিত রাগিণী শুনিয়েছেন। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, নিছক নির্বাচনী জোট তৈরি করে আসন ভাগাভাগি এবং যৌথ প্রচারের গতে বাঁধা রণকৌশল আজ আর যথেষ্ট নয়, ভারতীয় রাজনীতির মধ্যমঞ্চের দখলদার বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের প্রতিস্পর্ধী বিকল্প রাজনীতির সুস্পষ্ট ধারণা ছাড়া এই শাসকদের মোকাবিলা কেবল কঠিন নয়, দুঃসাধ্য। ত্রিপুরা কখনওই গোটা দেশের প্রতিনিধি হতে পারে না, কিন্তু এ-রাজ্যের অভিজ্ঞতা আরও এক বার দেখিয়ে দিল যে, সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন তার মৌলিক চরিত্রে দলিত এবং জনজাতি জনসমাজের স্বার্থের পরিপন্থী হলেও বাস্তব রাজনীতির পরিসরে বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর আত্মপরিচিতি এবং উন্নয়নের দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চেতনা ও সংগঠন অন্তত সাময়িক ভাবে বিজেপির পক্ষে দুুঃসংবাদ নয়। মণ্ডল বনাম কমণ্ডলুর পুরনো ছক ভেঙে গিয়েছে। জনজাতি স্বার্থও কমণ্ডলুর পেটে ঢুকে যাচ্ছে। বিরোধী রাজনীতির সামনে দুস্তর পারাবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy