বলা হয়েছিল, মুসলমান সমাজের সার্বিক ‘উন্নতি’র জন্যই ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ হওয়া প্রয়োজন। বাস্তবে দেখা গেল মুসলমান সমাজের মতামতের তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাশ হল এই বিল। যতই বিল পাশ-অন্তে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনাকে আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা এবং সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত বলে দাবি করুন, বিল পাশকে কেন্দ্র করে ভারতের সংখ্যালঘু সমাজের এক বৃহদংশের ক্ষোভ প্রত্যাশিতই ছিল। সাম্প্রতিক কালে পশ্চিমবঙ্গে তারই প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে। ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ যেমন শেষ পর্যন্ত রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায়। জঙ্গিপুর মহকুমায় দিনকয়েকের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। এবং সুতি ও রঘুনাথগঞ্জ থানা এলাকায় জারি করা হয়েছে ১৬৩ ধারা। অর্থাৎ, বঙ্গে সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশটি আরও এক বার বিভাজনের রাজনীতির চাপে বিঘ্নিত হওয়ার মুখে।
এই পরিস্থিতি অপ্রীতিকর এবং অনভিপ্রেত। কোনও বিল আইনে পরিণত হয়ে যাওয়ার পর এই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলি কোনও সুসংগঠিত সমাধানের পথ দেখায় না, বরং মেরুকরণের রাজনীতিকেই আরও পুষ্ট করে, সংখ্যালঘু সমাজের প্রতি বিরাগ বাড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রতিবাদ ন্যায্য ও সঙ্গত হলেও প্রতিবাদের ধরনটিকে গণতান্ত্রিক পথে রাখাই কাম্য। যে পদ্ধতিতে কোনও নাগরিক বিতর্ক ছাড়াই দেশের সংখ্যালঘুদের ধর্ম-সংক্রান্ত এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিল পাশ হল, প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন সেই পদ্ধতিটি নিয়ে, সেই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবটিকে নিয়ে। কিন্তু অ-গণতান্ত্রিক উপায়ে একটি বিল পাশ করা হয়েছে বলে তার প্রতিবাদে সেই অ-গণতান্ত্রিকতারই আশ্রয় নেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। তার জন্য আইনি পথ রয়েছে, গণতন্ত্রের সর্বোত্তম অস্ত্র নির্বাচন রয়েছে। তদুপরি, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতটিও স্মরণে রাখা প্রয়োজন। প্রতিবেশী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই রাজ্যের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে অবিশ্বাসের আক্রমণ। এক দিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন, অন্য দিকে ভারতের কেন্দ্রে সংখ্যাগুরুবাদে প্রবল বিশ্বাসী সরকারের ‘উন্নতি’র অছিলায় সংখ্যালঘুর ধর্মীয় পরিসরটিতে ঢোকার অন্তহীন প্রচেষ্টা— এই দুইয়ের মাঝে এখন যে কোনও ইন্ধনে পা দেওয়া আত্মঘাতের শামিল।
সর্বোপরি, নাগরিক সম্পত্তি ভাঙচুর কোনও সুস্থ আন্দোলনের পরিচয় হতে পারে না। যে কোনও প্রতিবাদের ক্ষেত্রেই প্রতিবাদীদের একাংশের এই পথে হাঁটার প্রবণতা থাকে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আন্দোলনের নেতাদেরই। মনে রাখা প্রয়োজন, যে রাজ্যের সম্পত্তি ভাঙচুর করা হল, এবং যে পুলিশকে ক্ষোভ প্রকাশের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তোলা হল, সেই রাজ্যে শাসক দল এই বিলে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ এবং তৎপরবর্তী পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের। ইতিমধ্যেই স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের পাশে থাকার এবং তাঁদের সম্পত্তি রক্ষার আশ্বাস দিয়েছেন। আপাতত সেই আশ্বাসে আস্থা এবং বিভাজন-উস্কানিতে ভেসে না গিয়ে শান্তি বজায় রাখা— দায়িত্বশীল নাগরিকের কাছে এইটুকুই কাম্য।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)