পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সামনে দাঁড়িয়ে অনুগামী ও সহকর্মীদের পরিচালনা করা নেতৃত্বের স্বধর্ম বলেই গণ্য হয়। প্রশংসিতও। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের নেত্রী সেই ধর্ম পালনে অনিচ্ছুক বা অপারগ, এমন অপবাদ তাঁর অতি বড় সমালোচকও দেবেন না। তাঁর দীর্ঘ, ঘটনাবহুল ও বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় কখনও আড়ালে থাকেননি, যে কোনও উপলক্ষে সামনে দাঁড়িয়ে (এবং হেঁটে) দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন। তাঁর সম্পর্কে বরং এই প্রশ্ন অনেক বার উঠেছে, সমস্ত ক্ষেত্রে এত বেশি সামনে থাকা কি দলনেত্রীর পক্ষে বিধেয়? কিংবা শোভন? এই আচরণ কি বাধাবন্ধহীন আত্মপ্রচারের শামিল নয়? এতদ্দ্বারা তিনি নিজের অবিসংবাদিত ক্ষমতাই সর্বদা এবং সর্বত্র জাহির করতে আগ্রহী কি না, সে-প্রশ্নও অশ্রুত থাকেনি। কিন্তু ইদানীং তাঁর কিছু উক্তির কল্যাণে এই প্রশ্নমালায় যুক্ত হয়েছে একটি নতুন সংশয়। মন্ত্রিসভার কিছু সহকর্মী এবং দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ক্রমশই জোরদার হচ্ছে, অধুনা মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ— পাশাপাশি লোকশ্রুতিতেও তা উত্তরোত্তর ছড়িয়ে পড়ছে। রাজনীতি-দক্ষ অভিজ্ঞ নেত্রী নিশ্চয়ই জানেন, পরিবারের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ লোকসমাজে প্রচারিত হলে তাঁর নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই অতঃপর বড় রকমের সমস্যা হতে পারে। হয়তো সেই কারণেই তিনি নিজের দুর্নীতিমুক্ত জীবনযাপনের কথা প্রচারে এখন বিশেষ সরব হয়ে উঠেছেন। এ বিষয়ে তিনি কখনওই নীরব ছিলেন না, কিন্তু গত সপ্তাহে দলীয় ছাত্র-যুব সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে পারিবারিক ভদ্রাসনের মালিকানা থেকে শুরু করে নিজের উপার্জন ও সংসার খরচের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা কিছুটা অভিনব।
নিন্দকেরা হয়তো বলবেন, দলের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর আয়ের সঙ্গে সম্পত্তির অসঙ্গতি নিয়ে এত কথা চলছে বলেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগ বাড়িয়ে নিজের সঙ্গতি নিজেই প্রচার করতে চাইছেন। কিন্তু এই ধরনের কু-জল্পনা সরিয়ে রেখে একটি গভীরতর প্রশ্ন তোলা আবশ্যক। মুখ্যমন্ত্রীকে হেয় করবার জন্য নয়, তাঁর পদটির মর্যাদাকে চিহ্নিত করবার জন্যই আবশ্যক। এই মর্যাদা রক্ষার উপায় বা প্রকরণ সকলের ক্ষেত্রে হুবহু এক হয় না, হওয়ার দরকারও নেই। কোনও মুখ্যমন্ত্রী (বা অন্য পদাধিকারী) নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে অতিমাত্রায় নিভৃত রাখতে তৎপর, কেউ আবার অনেক বেশি খোলামেলা, কেউ অস্বাভাবিক মিতবাক, একটি বাক্যও সম্পূর্ণ করেন না, কারও আবার আপন সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুরাগ ও জ্ঞান জাহির করবার চেষ্টা অহরহ উপচে পড়ে। এমন বৈচিত্র অস্বাভাবিক নয়, অসঙ্গতও নয়। এই স্বাভাবিকতার অনুশীলন করতে গিয়ে নিজের জীবনকে জনতার হাটে মেলে ধরলে কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যদি জনসমাবেশে জমি-বাড়ির দলিল-দস্তাবেজের বিবরণ দিতে শুরু করেন, বিসদৃশ শোনায় না কি? যে তাগিদে বা তাড়নাতেই তিনি এই আত্মকথা নিয়ে কথকতা করে থাকুন, মুখ্যমন্ত্রীর মুখে তা মানায় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জননেতা বা প্রশাসকদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে বহুকাল ধরেই বিস্তর চর্চা হয়ে এসেছে। সেই চর্চায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য প্রশাসকের কোনও আগ্রহ আছে, এমন কথা ভাবা কঠিন। তাঁকে বাক্-সংযম বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কথা সম্ভবত তাঁর বলয়বাসীরা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞ নেত্রী, নেতৃত্বের প্রয়োজনেই নিজে একটু এই বিষয়ে ভেবে দেখতে পারেন। কোন কথা বললে লোকে তাঁকে ভোট দেবে, বা তাঁর জন্য হাততালি দেবে, শুধু সেটাই তো জননেত্রীর একমাত্র বিচার্য হওয়া ঠিক নয়— সম্মান এবং মর্যাদার দাবিটি ঈষৎ আলাদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy