Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
Madavpur Fair

মেলা এবং না-মেলা

পাঁচ দিনের এই মেলার নেপথ্য কাহিনিটি এই সুযোগে মনে করে নেওয়া যেতে পারে। সে কাহিনি শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে।

মাধবপুর মেলা।

মাধবপুর মেলা। —ছবি : সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৩ ০৫:৩৭
Share: Save:

এক দশকও কাটেনি। উত্তর-পূর্বের জনজাতি নারীদের সসম্মানে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের বিতর্কে নিয়ে আসা যে কত কঠিন, প্রমাণ করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের দুই ঘণ্টাব্যাপী জবাবি বিতর্কে কয়েক সেকেন্ড তিনি এ বিষয়ে ব্যয় করলেন, স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতাতেও কিছু কথা বললেন, কিন্তু এ সবই— বিলম্বের তুলনায় অতি স্বল্প, অতি অবহেলাময়। অথচ, মোদী মহাশয়ই মাধবপুর মেলার খোদ স্রষ্টা। এ বারেও ৩০ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল অবধি পোরবন্দরের মাধবপুর সৈকতে মেলা বসেছে, সেখানে মেঘালয়, অরুণাচলের কয়েক জন মন্ত্রীর সঙ্গে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র পটেল ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু উপস্থিত থেকেছেন। রিজিজু সেখানে ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’ মন্ত্র আওড়েছেন। কিন্তু চার মাস বাদে, সংসদে মণিপুর নিয়ে অনাস্থা বিতর্কে অবশ্য রিজিজু বা তাঁর উপরওয়ালা কারও মুখেই উত্তর-পূর্বের সম্মান ও সাংস্কৃতিক সংহতির প্রতি সেই দায়িত্বের কথা শোনা যায়নি। সকলের অজ্ঞাতসারে সব প্রতিশ্রুতি গুজরাতের সমুদ্রসৈকতেই পড়ে থাকল।

পাঁচ দিনের এই মেলার নেপথ্য কাহিনিটি এই সুযোগে মনে করে নেওয়া যেতে পারে। সে কাহিনি শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে। অরুণাচলের ইদু মিশমি জনজাতির গল্প, ভীষ্মক তাঁদের রাজা ছিলেন। রুক্মিণী তাঁরই মেয়ে। ভীষ্মক চেদিরাজ শিশুপালকে কন্যাদান করবেন ভেবেছেন। কিন্তু রুক্মিণী প্রাণমন সমর্পণ করে দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণকে একটি প্রেমপত্রও পাঠিয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকা থেকে এসে রুক্মিণীকে হরণ করে নিয়ে যান। মাধবপুরেই সেই বিয়ে হয়েছিল। সেই উৎসবের স্মরণেই গুজরাতের পাটোলা শাড়ি, উত্তর-পূর্বের মেখলা, সারং নিয়ে জমাটি প্রদর্শনী ও মেলা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গুজরাতি গরবা নাচ থেকে মণিপুরি নৃত্য। প্রথম বারের মেলায় গিয়ে রিজিজু ও উত্তর-পূর্বের নেতারা বলেছিলেন, তাঁরা কনেপক্ষ। বরযাত্রীদের স্বাগত জানাতে এত দূরে এসেছেন। মৌখিক ঐতিহ্যে মিথের শক্তি প্রবল। অসম, অরুণাচলের মিশমিরা কেউ কেউ আজও মাথার চুলের সামনের অংশটা কেটে রাখেন। তাঁদের রাজকন্যাকে নিয়ে পালানোর সময় শ্রীকৃষ্ণ নাকি প্রাণে না মেরে ওই ভাবেই তাঁদের কেশকর্তন করে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অরুণাচলের জনজাতি-অধ্যুষিত রোয়িং শহরের কাছে এখনও আছে ভীষ্মকের রাজপ্রাসাদ ও দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। অরুণাচলের মালিনিথান শিবমন্দিরে থেমেছিলেন তাঁরা, পলায়নপর প্রেমিক-প্রেমিকাকে শিব ও দুর্গা সাদর অভ্যর্থনা জানান।

উত্তর-পূর্বের জনজাতিদের অনেকে অবশ্য জানাচ্ছেন, সত্তর দশকের আগে এই উপকথাটি তাঁরা শোনেননি। বলা বাহুল্য, ওই সময়েই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বামী বিবেকানন্দ সরস্বতী বিদ্যামন্দির, জনজাতি বিকাশ সমিতি, ভারত বিকাশ পরিষদ ইত্যাদি শাখা সংগঠনগুলি উত্তর-পূর্বে শিক্ষাবিস্তার, সমাজসেবার মাধ্যমে হিন্দুত্ব প্রচার শুরু করে। আনো তাজু নামে এক মিশমি চরিত্রকে কৃষ্ণ বানানোর চেষ্টা করা হয়, রুক্মিণীকে ইদু জনজাতির কন্যা। ভীষ্মকনগর নামটা পুরনো। ব্রিটিশ আমল থেকেই ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানেন, সেখানকার রাজাদের নিজস্ব নৌবাণিজ্য ছিল, অসমের অহোম রাজাদের তাঁরা পর্যুদস্তও করেন, যদিও শেষে অহোম রাজারা তাঁদের যুদ্ধে হারান। কিন্তু মানচিত্রে স্থানীয় নাম ও উপকথায় হিন্দু প্রলেপ ষাট-সত্তরের দশক থেকেই সঙ্ঘের প্রিয় বিষয়। তাঁদের প্রচারপুস্তিকা জানায়, নাগাল্যান্ড নাগকন্যা উলূপীর রাজ্য, অসম মানে তন্ত্রপীঠ কামরূপ, মেঘালয় হল মার্কণ্ডেয় পুরাণের প্রাণবিজয় রাজ্য। মণিপুর হল চিত্রাঙ্গদার পুত্র বভ্রুবাহনের রাজ্য। এর সঙ্গে মিলে যায় সাভারকরের তত্ত্ব— সপ্তসিন্ধুর এ পারে জনজাতিরা সকলেই হিন্দু। অর্থাৎ মোগলসরাইকে দীনদয়াল উপাধ্যায় আর ইলাহাবাদকে প্রয়াগরাজ করার যে পদ্ধতি, নামাবলির সেই ইতিহাস উত্তর-পূর্বেই শুরু হয়েছিল। প্রাচীন ইতিহাস, কথা-উপকথা না জেনেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলিকে সে সময় ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন উত্তর-পূর্বের জনজাতিরাও, অন্যরাও। আজ সেই মাঠে নতুন খেলা শুরু হয়েছে। শুধু নারীর অপমান, আর ঘৃণার বেসাতি বনাম ভালবাসার দোকান গোছের কথায় এই অজ্ঞান অন্ধকার এবং অন্ধকার উদ্‌যাপনের খেলা থামানো যাবে কি? আশঙ্কা হয়, মাধবপুর মেলায় গুজরাত প্রতাপশালী বরপক্ষ আর উত্তর-পূর্ব ভারত ভয়ার্ত কন্যাপক্ষ হয়েই থেকে যাবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Gujarat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE