গণতন্ত্রের মূল সুরটি ইদানীং এই ভারতে আপনা হইতে তত বাজে না বলিয়াই বারংবার বাজাইতে হয়। কখনও নাগরিক সমাজ, কবি, কৃষক, ছাত্রকুলের প্রতিবাদে, কখনও আদালতের নির্দেশ বা রায়ে সেই সুর বাজিয়া উঠে— প্রশাসন ও আইনতন্ত্রকে মনে করাইয়া দেয় সংবিধানের তাৎপর্য, গণতন্ত্রে অধিকারের অর্থ। গুজরাত হাই কোর্ট সম্প্রতি আমদাবাদ পুরসভাকে ভর্ৎসনা করিল— কারণ, পুর-প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি জারি করিয়া রাস্তায় আমিষ খাদ্যের স্টল বন্ধ করিয়া, খাবারের গাড়ি বাজেয়াপ্ত করিতেছিল। আমিষ খাদ্যের প্রকাশ্য অস্তিত্ব ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহার ধোঁয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ— প্রশাসনের এই সব যুক্তি উড়াইয়া বিচারপতির প্রতিপ্রশ্ন, নাগরিক কী খাইবেন, প্রশাসন তাহা ঠিক করিয়া দিবে? আজ বাহিরের খাবারে, কাল বাড়ির খাবারে বাধানিষেধ আসিবে?
আসল কথা যে এইটিই— সংবিধান-স্বীকৃত নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ নহে, বরং তাহার সর্বৈব রক্ষণ ও নিশ্চিতি— একের পর এক ঘটনা বা মামলায় তাহা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে ভারতের আদালত। ২০১৭ সালে ক্ষমতায় আসিয়া যোগী আদিত্যনাথের সরকার উত্তরপ্রদেশে কসাইখানাগুলির ঝাঁপ ফেলিতে তৎপর হইয়াছিল, আইনি অবৈধতার যুক্তিতে। মামলা হইলে ইলাহাবাদ হাই কোর্ট পত্রপাঠ বলিয়াছিল, খাদ্য, খাদ্যাভ্যাস এবং সংশ্লিষ্ট জীবিকাসমূহ তর্কাতীত ভাবে জীবনের অধিকারের সহিত জড়িত, সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ যে অধিকার নিশ্চিত করিয়াছে। প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ বা পদক্ষেপ সেই মৌলিক অধিকারে বাধা হইলে তাহা অসাংবিধানিক, অবৈধ। মহারাষ্ট্রে পুরাতন এক আইনে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ও জামিন-অযোগ্য অপরাধ ঘোষিত হইয়াছিল, যাহার অর্থ: পুলিশ চাহিলে নাগরিকের রান্নাঘরে ঢুকিয়া দেখিতে পারিবে তিনি কী খাইতেছেন। পরে বম্বে হাই কোর্ট রায় দেয়, কেহ গৃহমধ্যে কী খাইবেন তাহা তাঁহার গোপনীয়তার অধিকার; নিজের ইচ্ছামতো, মর্যাদা সহকারে জীবন কাটাইবার অধিকার— ভারতের সংবিধান যাহাকে পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়াছে। এ-হেন ঘটনায় অভিযুক্তকেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করিতে হইবে, আইনের এই অংশও অবৈধ ঘোষণা করিয়া আদালত বলিয়াছিল, ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘বেআইনি’ ঘোষিত খাদ্য সরবরাহের সময় পুলিশ কাহাকেও আটক করিলে প্রশাসনেরই দায় ইহা প্রমাণ করা, অভিযুক্ত বেআইনি জানিয়াও ওই কাজ করিতেছিল। সার কথা, আইন ভঙ্গ না করিলে বা অন্যের প্রাণসংশয়ের হেতু না হইলে, নাগরিকের খাদ্যাভ্যাসে প্রশাসন তথা রাষ্ট্রের নাক গলাইবার কোনও কারণ নাই।
আইন যখন বিরুদ্ধ, প্রশাসনই যখন বিরূপ, তখন নাগরিকের ভরসা বিচারব্যবস্থাই। ভারতে গণতন্ত্র যে শ্বাস লইতে পারিতেছে তাহার কারণ, ভারতের আদালত সংবিধান ও নাগরিক অধিকার রক্ষণের কথাটি রাষ্ট্রকে নিয়ম করিয়া, নরমে-গরমে মনে করাইয়া দিতেছে। বুঝাইয়া দিতেছে প্রকৃত ‘আইনের শাসন’-এর অর্থ, যাহাতে গণতন্ত্র-দীপের তলায় রাষ্ট্রীয় আধিপত্যবাদের অন্ধকার কদাপি ঘনাইতে না পারে। রাষ্ট্রনেতারা দেশ ও নাগরিক রক্ষার শপথ লইয়া থাকেন, সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার শপথ লইতে হয় বিচারকদেরও। নেতারা যেখানে মুহুর্মুহু প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করিতেছেন, আদালত ও বিচারকদের অখণ্ড দায়বদ্ধতাই সেখানে আশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy