আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে কোন বিষয়টি প্রধান হয়ে উঠতে চলেছে— জানিয়ে দিল চলতি বিধানসভার অধিবেশন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, কিংবা সোজা কথায়, চরম মুসলমান-বিদ্বেষের রাজনীতি হল সেই এক ও অদ্বিতীয় থিম। নেতারা বিধানসভার ভিতরে মুসলমান বিদ্বেষ বর্ষণ করে তার দায়ে নিলম্বিত হচ্ছেন, এবং বাইরে এসে অকুতোদ্বিধায় প্রবলতর ঘৃণা প্রচার করছেন: আপাতত এটিই বঙ্গীয় বিজেপির দলীয় কর্মসূচি। ব্যক্তি শুভেন্দু অধিকারী কী বলছেন, কী করলেন, সে নিয়ে উদ্বেগ অর্থহীন। বিষয়টি কোনও একক ব্যক্তির সমস্যা নয়, এই কর্মসূচি ভারতীয় জনতা পার্টি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সযত্ননির্ধারিত। ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষতি স্বীকারের পর হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র ও দিল্লির ভোটপর্ব বিজেপিকে বুঝিয়ে দিয়েছে, হারানো জমি ফিরে পেতে বিদ্বেষ-রাজনীতির জুড়ি নেই, ফলে আবারও সেই বহুপরীক্ষিত মুসলমান-আক্রমণে প্রত্যাবর্তন। এ বার যুদ্ধমঞ্চ খাস পশ্চিমবঙ্গ— যে রাজ্যে ২৯ শতাংশের কাছাকাছি মুসলমান জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে এই বিভেদ রাজনীতি বিশেষ ‘কার্যকর’ হয়ে উঠতে পারে। গত মাসে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-প্রধান মোহন ভাগবত পশ্চিমবঙ্গে দশ দিনের সফরে এসেছিলেন। তাঁর প্রত্যাগমনের পর বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা প্রকাশ কারাটের কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল যে ভাগবত-বার্তার পর বাংলায় যে কোনও পথে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ তৈরির প্রচেষ্টা চলবে। গত কয়েক দিনে সেই প্রয়াসটিই পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে হিন্দুত্ববাদ প্রসারের উদগ্র কার্যধারায়।
বিদ্বেষ তৈরি করে উল্টো বিদ্বেষ, বিভাজনের উত্তরে আসে আরও বিভাজন। সংখ্যালঘু সমাজের ভিতর থেকেও এখন ধ্বনিত হচ্ছে ধর্মান্ধতার স্বর। কোনও কোনও তৃণমূল নেতারও মুখনিঃসৃত বাক্যে বেরিয়ে আসছে ফেনিল ঘৃণা। শুভেন্দু অধিকারীর কদর্য বক্তব্যের উত্তরে হুমায়ুন কবীর ও সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বিধানসভায় পাল্টা সুর চড়ালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের নেতাদের মুখ বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছেন। কংগ্রেস ও সিপিএমের তরফেও ধর্ম-রাজনীতির নিন্দা শোনা গিয়েছে। তবে বিজেপির ‘অধ্যবসায়’ এই সব প্রয়াসকেই ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম। এই ঘৃণা-বিরাগ কুবাক্য-কুৎসার পরিসরটি ভোটের আগে আরও বাড়ার সম্ভাবনা, যা হয়তো কেবল রাজনীতি বলয়ে সীমিত থাকবে না, সামাজিক দূরত্ব ও বিদ্বেষও বাড়াবে। সত্যিই যদি বিদ্বেষ প্রচার আটকাতে হয়, এমনটুকরোটাকরা মন্তব্য বা নির্দেশের ঊর্ধ্বে উঠে গণপরিসরে অক্লান্ত ভাবে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে হবে। অথচ তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতাই সাম্প্রদায়িকতার ঘোলা জলে ভোট ধরতে উৎসুক। কংগ্রেস, সিপিএম ও অন্যান্য বাম দল তৃণমূল বিরোধিতায় যত সক্রিয়, বিজেপি-আরএসএস বিরোধিতায় তার অনেক কম। সর্বোপরি, প্রচারমাধ্যমের একাংশও এখন উগ্র হিন্দুত্ব প্রচারে অতি সক্রিয়— যার পিছনে বিভেদকামী রাজনীতির আনুকূল্য ও উৎসাহ সহজেই অনুমেয়।
হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির পরিসর বিনষ্ট হতে শুরু করলে সমাজ ও রাজনীতি কোন ভয়াবহ অতলে তলিয়ে যেতে পারে, চলমান সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে তার সমূহ উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। এই সময়ে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর অন্যতম উর্বর ক্ষেত্র— পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগ-বিড়ম্বিত বাস্তব। বিগত কয়েক বছর যাবৎ এই রাজ্যে রাজনীতি উন্মাদ হয়ে ছুটছে সেই উর্বর ভূমি কর্ষণ করে বিষভোট সংগ্রহ করে গোলায় তোলার লক্ষ্যে। অথচ আগুন এক বার জ্বললে শাসক বিরোধী উদার অনুদার বাম দক্ষিণ, সকলেরই ঘোর বিপদ, কেউ বাদ পড়বে না। ফলে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়ানোর হোতা ও নেতাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও জোরালো প্রতিবাদ চাই, এখনই। একই আগুনে বার বার বাংলাকে পুড়তে দেওয়া যাবে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)