ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মুদ্রণ-প্রযুক্তির পারঙ্গম ব্যবহারে, রামমোহন-বিদ্যাসাগরের মতো ভাষা-পরিকল্পকের সহায়তায়, বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথের মতো ভাষাশিল্পীর কুশলতায় বাংলা ভাষা ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল। উপনিবেশিত ভারতের রাজধানী ঊনবিংশ শতাব্দীতে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কলকাতা। কলিকাতা তখন কমলালয়। সুতরাং ধনে-গুণে বাংলা ও বাঙালির সে তখন বড় সুখের সময়। তবে সেই সুখের সময়েও বাঙালি চিন্তকেরা কেবল নিজ মাতৃভাষার আঁচলে মুখ লুকিয়ে থাকেননি। বৃহত্তর ভারত খেয়াল করেছিল বাঙালি ভদ্রলোকের ভাষাজ্ঞানের বিস্তৃতি। আধুনিক ভারতের অন্যতম রূপকার রামমোহন রায় ছিলেন বহুভাষী। আরবি-ফারসি-সংস্কৃত-হিন্দি-ইংরেজি তাঁর অধিগত। তাঁর বাংলা ভাষা এই বহুভাষা-জ্ঞানের ফলে উজ্জ্বল হয়েছিল। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত-ইংরেজি-বাংলাই শুধু জানতেন না, হিন্দিও খুবই ভাল জানতেন। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের স্মৃতিকথা থেকে জানা যাচ্ছে, তিনি বারাণসীর এক হিন্দিভাষী পণ্ডিতের সংস্কৃত প্রশ্নের উত্তর হিন্দিতে প্রদান করেছিলেন। হিন্দি থেকে অনুবাদ করেছিলেন বেতাল পঞ্চবিংশতি। রবীন্দ্রনাথও ত্রিভাষী— ইংরেজি, বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষার বই রচনা করেছিলেন তিনি। হিন্দি ভাষা না জানলেও সে ভাষার প্রতি তাঁর মনোভাব অনুকূল ছিল। তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিন্দি ভাষার বিশেষ মর্যাদা ছিল। ক্ষিতিমোহন সেন হিন্দি ভাষায় প্রাজ্ঞ ছিলেন বলে, রবীন্দ্রনাথ হিন্দি তেমন না জানলেও ক্ষিতিমোহনের কাছ থেকে মরমিয়া ভারতীয় কবিদের জীবন ও কাব্যের পরিচয় লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্র-কবিতায় সর্বভারতীয় ভক্তিবাদের স্পর্শ লেগেছিল। বহুভাষাজ্ঞ উচ্চমেধাসম্পন্ন চিন্তকেরা অবশ্য একটি কথা বুঝতে পেরেছিলেন, ইচ্ছে থাকলেও সকলের পক্ষে একাধিক ভাষা রপ্ত করা সম্ভব নয়। তাই নিজের ভাষাটি যাতে সর্বসাধারণের জ্ঞান ও চিন্তা প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ বাহক হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে নানা উদ্যোগ করেছিলেন তাঁরা। যাঁরা পারবেন বাংলা শিখে অন্য ভাষা অর্জন করবেন, অন্যরা শিক্ষার বিশেষ স্তর পর্যন্ত বাংলা ভাষার সাহচর্যেই লালিত-পালিত হবেন। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পরেও নানা বিষয়ে জানার ইচ্ছা থাকলে বাংলা ভাষায় উপযুক্ত বই যাতে হাতে পান, সে ব্যবস্থা এক রকম করে গড়ে উঠেছিল। অপর ভাষা শেখা সব সময়ই ভাল, কিন্তু নিজের ভাষা বাদ দিয়ে সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থাকে বলেই তাঁরা মনে করতেন। বাঙালি হয়েও বৈশ্বিক হতে তাঁদের অসুবিধা হয়নি।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে এই যুক্তরাষ্ট্রে ভাষাভিত্তিক রাজ্য নির্মাণের পর শিক্ষানীতিতে ভাষানীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘ইউনিভার্সিটি এডুকেশন কমিশন’ ১৯৪৮ সালে ত্রিভাষা নীতির কথা প্রথম বলেছিল। ১৯৬৮ সালে লোকসভায় ত্রিভাষা নীতি বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে। ইংরেজি, হিন্দি ও আর একটি নব্য ভারতীয় ভাষা রপ্ত করার কথা বলা হয়। হিন্দি বলয়ে এই তৃতীয় ভাষাটি হবে দক্ষিণ ভারতীয় একটি ভাষা, আর অ-হিন্দি ভাষীদের ক্ষেত্রে হবে হিন্দি-ইংরেজি ও স্থানীয় একটি ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক স্তরে বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থায় তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি কিংবা সংস্কৃত নেওয়ার রীতি ছিল। এই তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি কিংবা সংস্কৃত কোন শ্রেণি থেকে কোন শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে, সে বিষয়ে নানা সময় নানা বিধি। মোটের উপর ত্রিভাষা নীতি খুব নতুন কিছু নয়। নতুন শিক্ষানীতিতে প্রসঙ্গটি ফিরে এসেছে।
যখন এই নীতি ফিরে এল তখন ভাষার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে— বাঙালিরা নানা কারণে দিশাহারা। নিজভাষার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখেই যে অন্য ভাষাও অধিকার করা যায়, এই বোধটি নানা কারণে লুপ্ত হয়েছে। নিজভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও যত্ন বজায় না রেখেই এক দল সাধারণ বাঙালি ইংরেজি ও হিন্দি শিখতে তৎপর। ইংরেজি ও হিন্দির প্রতি তাঁদের এই আকর্ষণ সাংস্কৃতিক কারণে নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ এর পিছনে ক্রিয়াশীল। এই দুই ভাষা শিখলে আজকের যুগে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভবান হওয়া যাবে। ভাল করে শিখলে তো এক রকম হত, কিন্তু এখন যা হচ্ছে তাকে বলা চলে ‘ভাষার অশিক্ষা’। নিজের ভাষাটিও গিয়েছে, অপর ভাষাও অনধিগত। আর এক দল কেবলই যেন বাংলা ভাষার মধ্যে সাংস্কৃতিক সত্তাকে বন্দি করতে তৎপর। এই দুই মতবাদই বাঙালির সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। নিজের স্বাভাবিক ভাষাবোধের সুষ্ঠু অনুশীলনের মাধ্যমে স্বভাষা রপ্ত করে অন্য ভাষা শিক্ষাই উপকারী ও অর্থকরী ভাষানীতি।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)