Advertisement
E-Paper

বৈষম্যের পুঁজি

পুঁজি উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে, এমনকি সংখ্যালঘু বা জনজাতির ক্ষেত্রেও যতখানি ফলপ্রসূ হচ্ছে, দলিতদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:০৯
Share
Save

দলিত ব্যবসায়ীদের আয়ের হার অন্যান্য গোষ্ঠীর ব্যবসায়ীদের তুলনায় কম, এবং এই ফারাক কেবলমাত্র তাঁদের ‘দলিত’ পরিচয়ের জন্যই ঘটে চলেছে। একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র ফের ভারতের সমাজের গভীর, দীর্ঘমেয়াদি অসাম্যের ছবিটা সামনে নিয়ে এল। ব্যবসা ক্ষেত্রে দলিতদের রোজগারের চিত্র পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে যে, গড়ে ১৬% কম রোজগার করেন দলিত ব্যবসা-মালিকরা। গ্রাম বা শহরে অবস্থান, শিক্ষার হার, জমির মালিকানা, প্রভৃতি পার্থক্যকে হিসাবের মধ্যে ধরেও এই পার্থক্য থাকছে। কী ভাবে তাঁদের জাতি-পরিচিতি তাঁদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, দলিতদের ক্ষেত্রে ‘সামাজিক পুঁজি’ যথেষ্ট লাভজনক হয় না। যে কোনও ব্যক্তির সামাজিক চেনা-জানার পরিমণ্ডল, এলাকার আর পাঁচ জনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, এগুলি তাঁর কাজ-কারবারের অন্যতম আধার, সহায়ক। যাঁর চেনাশোনা যত বেশি, যিনি নিজের চার পাশের মানুষের আস্থাভাজন, ব্যবসায়ে তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনাও তত বেশি। তাই সামাজিক সম্পর্কের পরিধিকে বলা হয় ‘সামাজিক পুঁজি’। এই পুঁজি উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রে, এমনকি সংখ্যালঘু বা জনজাতির ক্ষেত্রেও যতখানি ফলপ্রসূ হচ্ছে, দলিতদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। যার অর্থ, ‘অস্পৃশ্য’ বলে দলিতদের গণ্য করা, তাঁদের সামাজিক বর্জনের যে ধারা ভারতের সমাজে দীর্ঘ দিন চলে আসছে, আজও তা সক্রিয়। তাই সমান উদ্যোগী, সমান পরিশ্রমী, সমান হারে সামাজিক-ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করার পরেও এক জন দলিত ব্যবসায়ী তাঁর চার পাশের মানুষের সমান আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেন না। দলিতদের বর্জন করে চলার প্রবণতা এতই বেশি যে, তার প্রতিফলন ধরা পড়ছে অর্থনীতির সমীক্ষায়, রোজগারের অঙ্কে। ‘মুক্ত’ বাজার জাতি-পরিচয়ের দুঃসহ ভার থেকে মুক্তি দিতে পারেনি দলিত ব্যবসায়ীদের।

ভারতের শ্রমের বাজারে দলিতদের অবস্থান নিয়ে গত বছর প্রকাশিত একটি বইয়ে (শিডিউলড কাস্টস ইন দি ইন্ডিয়ান লেবার মার্কেট: এমপ্লয়মেন্ট ডিসক্রিমিনেশন অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট অন পভার্টি, থোরাট, মাধেশ্বরন ও বাণী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) লেখকরা দেখিয়েছেন, দলিতদের প্রধানত কম মজুরির, অদক্ষ কাজে নিয়োগ করা হয়। কৃষি এবং নির্মাণকাজে দলিতদের উপস্থিতি বেশি, পরিষেবা, উৎপাদন, ব্যবসার ক্ষেত্রে তাঁদের কম দেখা যায়। উচ্চবর্ণের প্রার্থীদের তুলনায় নিয়মিত বেতনের কাজ পাওয়া দলিত প্রার্থীদের পক্ষে অনেক কঠিন, ফলে দলিতদের মধ্যে বেকারত্বের হারও বেশি। এমনকি উচ্চবর্ণ কর্মপ্রার্থীদের তুলনায় বেশি শিক্ষিত দলিত তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও কর্মহীনতা, এবং কাজ পাওয়ার জন্য অপেক্ষার হার অনেক বেশি। বেসরকারি ক্ষেত্রে নিযুক্ত দলিতদের বেতনের অঙ্কে বৈষম্য স্পষ্ট। এটা শহর ও গ্রাম, দু’ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে। কেবল দলিতদের শিক্ষা ও পেশাদারি প্রশিক্ষণ বাড়ালেই হবে না, কর্মক্ষেত্রে জাতিগত বৈষম্যের উপর নজরদারি, এবং জাতিবিদ্বেষকে শাস্তিযোগ্য করাও দরকার, মনে করছেন লেখকরা।

মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, দারিদ্র হল হিংসার সর্বাধিক তীব্র প্রকাশ। কর্মনিযুক্তিতে, ব্যবসায়, দলিতদের রোজগার-বঞ্চনা বস্তুত দরিদ্রের প্রতি হিংসা। সামাজিক রীতি মানার নামে এই হিংসাকে প্রশ্রয় দেওয়া অপরাধ। দলিত, জনজাতি, সংখ্যালঘু ও মহিলাদের প্রতি সমাজের বিদ্বেষ যে ভারতে দারিদ্রের অন্যতম কারণ, এ কথা বিভিন্ন সমীক্ষায় বার বার উঠে এসেছে। এই সব পরিসংখ্যান বস্তুত দেশবাসীর দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার খণ্ডচিত্র। দলিতদের প্রতি বৈষম্য ও অন্যায়ের শতসহস্র রূপ প্রতি দিন চার পাশে দেখা যাচ্ছে। তাতে তথাকথিত উচ্চবর্ণ, উচ্চশিক্ষিত, বিত্তবান শ্রেণির মানুষদের নিম্নরুচি, অশিক্ষা এবং দৈন্যই প্রকাশ পায়। জাতের নামে এই জালিয়াতি বন্ধ করার সময় এসেছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Minority

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}