নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, কোনও দেশকে ঠিকমতো চেনার উপায় হল তার কারাগারগুলির অবস্থা দেখা। সর্বোচ্চ স্তরের নাগরিকরা কেমন আছেন, তা দিয়ে কিছু বোঝা যায় না, বরং একেবারে নীচে, সবার অধম, দীনের হতে দীন যাঁরা, তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের ব্যবহার দেখে বোঝা যায় রাষ্ট্রের চরিত্র। সাতাশ বছর জেলের মধ্যে কাটিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই বিশ্ববরেণ্য নেতা। তাঁর কথাটিকে মান্য না করে উপায় নেই। আর মান্য করলে বলতে হয়, ভারতের দশা বিশেষ রকমের হতাশাজনক। রাষ্ট্রীয় নেতাদের ভাবা উচিত, দেশের কারান্তরিন জনতার প্রতি মানবিক আচরণ ফিরিয়ে আনার পথ কী। অতীব বেশি সংখ্যক অভিযুক্তকে জেলের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা, বিচারের জন্য অনন্ত অপেক্ষায় তাঁদের রেখে দেওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম জায়গায় শারীরিক ভাবে তীব্র অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে বন্দিদের রাখা, এবং তজ্জনিত নিরাপত্তা-অভাবের মধ্যে তাঁদের ঠেলে দেওয়া, নির্যাতনের ফলে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার শিকার করে ফেলা, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা, মানবিক বিবেচনার কোনও স্পর্শ না রাখা, সব মিলিয়ে ভারতের প্রায় সব ক’টি জেলই অভিযুক্ত বন্দিদের এক নরকযন্ত্রণায় নিক্ষিপ্ত করার বন্দোবস্ত বলা যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালে কিছু সংবাদে বিবেকবান নাগরিক আবার ধাক্কা খেলেন। দেশের একটি মাত্র জেল— পুণের ইয়েরওয়াড়ার দিকে যদি তাকাই: গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক বন্দির আত্মহনন, কিংবা নিরাপত্তারক্ষীর উপর বন্দিদের ভয়ঙ্কর আক্রমণ, সাতাশ বছরের তরুণ বন্দিকে সম্মেলক আক্রমণে মেরে ফেলা, কিংবা উপর্যুপরি বন্দিদের পলায়ন ইত্যাদি। এই ভারতে বন্দিরা কেমন আছেন, বন্দিদের হাল থেকে রাষ্ট্রের পরিস্থিতি কেমন মনে হয়— ইত্যাকার প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন নয়, খবরগুলিতে চোখ-রাখা মাত্রই।
ইয়েরওয়াড়া জেলটি যে-কোনও কারাগার নয়, ইতিহাসগত ভাবে অতি বিশিষ্ট। এর কোণে কোণে রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব লুকিয়ে। এই সেই জেল যেখানে মহাত্মা গান্ধী একাধিক বার অন্তরিন হয়েছেন উনিশশো বিশ, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে— অসহযোগ আন্দোলনের পর, আইন অমান্য আন্দোলন চলাকালীন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের শেষ দিকে। এই সেই জেল যেখানে তিনি সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার বিরুদ্ধে আমরণ অনশন ব্রত শুরু করেছিলেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে, ফলের রস খেয়ে তাঁর অনশন ভঙ্গ হয়েছিল। এই সেই জেল যেখানে স্বাধীনতার পরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ঠাঁই পেয়েছেন, যেমন ইন্দিরা গান্ধী। এই সেই জেল যেখানে ভয়ানক মাপের ও মানের অপরাধীর জায়গা হয়েছে, যেমন মুম্বইয়ের তাজ-ঘটনার পর সন্ত্রাসবাদী আজমল কাসবের। জেলের মধ্যেও যদি কোনও এলিট গোষ্ঠী থাকে, তার মধ্যেই নিশ্চিত এর স্থান। এতদ্ব্যতীত, দেশের যে যে জেলের মধ্যে এখন ‘ওপেন প্রিজ়ন’ বা অনাবদ্ধ কারাগারের ব্যবস্থা হয়েছে, তার মধ্যে ইয়েরওয়াড়া অন্যতম। এই ব্যবস্থানুসারে খোলা জায়গায়, তুলনায় অনেক কম বাধানিষেধের মধ্যে, স্বাভাবিক জীবনছন্দে অপরাধীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়— যাঁরা ইতিমধ্যেই সুমতিপরায়ণ বন্দি হিসাবে কর্তৃপক্ষের আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করেছেন, সেই বন্দিদের জন্য এমন ব্যবস্থা করা বিশ্বময় আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্রের আচরণীয় প্রথা। এমন একটি জেল থেকেও যদি একের পর এক এমন সংবাদ আসে, কখনও বন্দির আত্মঘাত, কখনও নৃশংস আক্রমণ, কখনও দুরতিক্রম্য প্রাচীর পেরিয়ে পলায়ন, তা হলে বলতে হয় ভারতীয় রাষ্ট্রের দিক থেকে গভীর পুনর্বিবেচনা জরুরি— তার জেলজীবনের মান বিষয়ে।
মহারাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান সংশোধনাগার ইয়েরওয়াড়া জেল, তবুও তার হাল এমন করুণ। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতোই উত্তর-উপনিবেশিক সভ্যতার মার্কা হিসাবে সংশোধনাগারের মধ্যেই রয়ে গেছে গোড়ার গলদ, রয়ে গিয়েছে দমননীতির আতিশয্য। অথচ আধুনিক গণতন্ত্রে অকারণ দমন-প্রকরণ থাকার কথা ছিল না, সুস্থ ভাবে বন্দিদের থাকার ব্যবস্থা করার কথা ছিল। তাঁদের চিকিৎসার অধিকার দেওয়া, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য দুই দিকেই খেয়াল রাখার কথা ছিল, যে-হেতু অত্যল্প স্থানে কোনও বন্দির অসুস্থতা অন্যদেরও বিপন্ন করতে পারে। মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুতর হওয়া উচিত ছিল। আসলে, মানবিকতা এমন এক শর্ত, যা সর্বত্র সমান ভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা— অন্দরে বাহিরে, অন্তরে প্রকাশ্যে। সে দিক দিয়ে, ভারত আজ কোন পথে— প্রশ্নটির উত্তর আশাজনক নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy