Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Narendra Modi

দায়বদ্ধ

সৃষ্টিশীলতার পরিসরও নিরুপদ্রব নহে, রন্ধ্রপথে নিষ্প্রশ্ন ও নির্লজ্জ রাষ্ট্রবাদী সমর্থনের সাপ ঢুকিয়াছে।

পারুল কক্কর।

পারুল কক্কর। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২১ ০৫:৫১
Share: Save:

শিল্প আয়না নহে, হাতুড়ি— লিখিয়াছিলেন বের্টোল্ট ব্রেশট। গালিলেও নাটকে বলিয়াছিলেন সত্যকথক শিল্পীর পাঁচটি চ্যালেঞ্জের কথা: প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়িয়াও সত্য লিখিবার সাহস, সত্য গোপনের আবহেও তাহাকে খুঁজিবার ঈপ্সা, সত্যকে অস্ত্র করিয়া তুলিবার দক্ষতা, সত্য রক্ষিত ও কার্যকর হইবে এমন ভরসার মানুষ খুঁজিয়া বার করিবার বিচারবোধ, এবং তাঁহাদের ভিতরে সত্যকে চারাইয়া দিবার সক্রিয়তা। গুজরাতি কবি পারুল কক্করের কবিতা সম্প্রতি তোপের মুখে পড়িয়াছিল, সমসময় ও সমাজের সত্যকে তুলিয়া ধরিয়াই। শববাহিনী গঙ্গা আর উপচাইয়া পড়া শ্মশানের ছবি আঁকিয়া, দেশের ‘রাজা’র দিকে আঙুল তুলিয়াছিল কবিতাটি। ফলস্বরূপ বিদ্রুপ, বিরোধিতা কম আসে নাই, সমাজমাধ্যম ট্রোল-এ ছাইয়াছিল। অতি সম্প্রতি কবিতা ও কবি উভয়কেই কাঠগড়ায় তুলিয়াছে গুজরাত সাহিত্য অ্যাকাডেমি। অভিযোগ, অ্যাকাডেমির সভাপতি এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখিয়াছেন, এই কবিতা তথাকথিত উদারবাদী, ‘লিটারারি নকশাল’দের অরাজকতা তৈরির চেষ্টা, কেন্দ্রের জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রভাবিত করিবার কল। এমনও বলা হইয়াছে, এই কবিতাটি খারাপ কিন্তু কবিটি ভাল, ভবিষ্যতে ‘ভাল’ লিখিলে পাঠকেরা নিশ্চয়ই তাঁহার কবিতা পড়িবেন।

খেয়াল করিবার, লেখকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলিতেছে এমন এক প্রতিষ্ঠান, সাহিত্যের মধ্য দিয়া সত্যের পরিপালন ও পোষণ যাহার কাজ। এমন প্রতিষ্ঠানও যখন কবি ও কবিতাকে সমাজ ও সময়ের সত্যে নহে, কেন্দ্রমুখী রাজনৈতিক মতাদর্শের নিক্তিতে বিচার করিতে বসে, এমনকি লেখক কী লিখিবেন না লিখিবেন প্রকারান্তরে সেই নিদানও ঘোষণা করে, তাহা অতি দুর্ভাগ্যের। বিরুদ্ধস্বর মাত্রেই রাষ্ট্র বা দেশবিরোধিতা, এযাবৎ এই কথা উঠিত রাজনীতির পরিমণ্ডলে, কিন্তু গুজরাতের ঘটনা বুঝাইতেছে, অসহিষ্ণুতা এখন সমাজ-পরিসরেও ঢুকিয়া পড়িয়াছে, দল বা রাষ্ট্রের ঘোষিত মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সাহিত্য ও সাহিত্যিককে তুলিয়া ধরিবার উদারতা ভুলিয়াছে সাহিত্য প্রতিষ্ঠানও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, সমাজকর্মী, সাংবাদিকের উপরে এর আগে রাষ্ট্ররোষ নামিয়া আসিয়াছে, প্রতিবাদী কবিও কারারুদ্ধ হইয়াছেন, সবই হইয়াছে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের সরাসরি হস্তক্ষেপে। কিন্তু সমসময়ের অন্ধকারকে এক কবি কবিতার সত্যে তুলিয়া ধরায় তাঁহারই সহলেখক বা সম্পাদক তাঁহাকে কোণঠাসা করিলে বুঝিতে হয়, সৃষ্টিশীলতার পরিসরও নিরুপদ্রব নহে, রন্ধ্রপথে নিষ্প্রশ্ন ও নির্লজ্জ রাষ্ট্রবাদী সমর্থনের সাপ ঢুকিয়াছে।

গুজরাতের দেড়শত বুদ্ধিজীবী অ্যাকাডেমির এই আচরণের প্রতিবাদে যৌথ বিবৃতি দিয়াছেন। মনে করাইয়া দিয়াছেন, অ্যাকাডেমি একটি গণতান্ত্রিক ও সাহিত্যসেবী প্রতিষ্ঠান, উহা যেন কোনও ভাবেই লেখকের লিখিবার স্বাধীনতা খর্বের কারণ হইয়া না দাঁড়ায়, তাহা দেখিতে হইবে। ইতিহাস সাক্ষী, হিটলারের জার্মানি, মুসোলিনির ইটালি বা ফ্রাঙ্কোর স্পেন, যখনই যেখানে একনায়কতন্ত্র ডানা মেলিয়াছে, তাহা শৈল্পিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কুক্ষিগত করিতে চাহিয়াছে। সেই মতলব শেষ পর্যন্ত খাটে নাই, প্রতিষ্ঠানগুলির সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতায়। আজিকার ভারতেও সেই দায়বদ্ধতা দেখাইবার পরীক্ষা।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi COVID19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy