ই দানীং ভারতে প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখিতে যাইবার বিড়ম্বনা প্রচুর। জাতীয় সংগীত বাজানো হইবে, তাহাতে উঠিয়া না দাঁড়াইলে প্রহৃত হওয়ার সম্ভাবনা বিলক্ষণ। দেশপ্রেম তবু সহিয়া লওয়া যায়, কিন্তু তামাকু সেবনের অপকারিতা বিষয়ে এমন ভয়াবহ সতর্কীকরণ চলিতে থাকে, এবং এত বেশি সময় ধরিয়া, এক সময় তাহা গ্রহণ করা কঠিন হইয়া উঠে। এমনিই নিয়ম হইয়াছে, যতগুলি দৃশ্যে কোনও চরিত্রকে ধূমপান করিতে দেখানো হইবে, প্রতিটি দৃশ্যের নিম্নে লিখিয়া দিতে হইবে যে এই অভ্যাস স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক। তদুপরি ছবি শুরু হইবার পূর্বে দুইটি কি তিনটি ভাগে বিভক্ত বিজ্ঞাপন চলে, সেইখানে বিশদ ছবির সাহায্যে বুঝানো হয়, সিগারেট খাইলে ফুসফুসের কী অবস্থা ঘটে, ধূমপানজনিত ক্যানসার রোগ ধরিলে মানুষের ফুসফুস ও স্বাস্থ্য কেমন হইয়া যায়, ক্ষতগুলিই বা কী রূপ দেখিতে হয়। ছবির বিরতির পর, যখন দ্বিতীয়ার্ধ আরম্ভ হইবে, পুনরায় ওই দগদগে ঘা প্রদর্শন আরম্ভ হইয়া যায়। সতর্কীকরণগুলি অবশ্যই জরুরি, এবং ছবি দেখিবার কালে এইগুলি দেখাইলে অনেকেই দেখিতে-শুনিতে বাধ্য হন, ফলে কিছু অংশ তাঁহাদের মগজে হয়তো প্রবেশও করে, কিন্তু ছবি দেখিবার মেজাজটি নষ্ট করিতে, এবং সর্বোপরি, ছবিটি হইতেও মনোযোগ সরাইতে এই বিজ্ঞাপনগুলি সিদ্ধহস্ত। তাহার অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: এই সতর্কবাণী শুনাইয়া কোনও লাভ হইতেছে কি? অধিকাংশ মানুষ কি সত্যই একটি অভ্যাস ক্ষতিকর জানিলে তাহা হইতে নিরস্ত হন?
আমেরিকায় একটি সমীক্ষার ফলকে যদি বিশ্বাস করিতে হয়, তাহা হইলে, সতর্ক করিবার বদলে, পয়সার লোভ দেখাইলে মানুষ অনেক দ্রুত ও কার্যকর ভাবে ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করিতে পারে। দিনে দশটির অধিক সিগারেট খাইবার অভ্যাস রহিয়াছে এবং সেই অভ্যাস ত্যাগ করিবার ইচ্ছা রহিয়াছে, এমন সাড়ে তিন শত মানুষকে লইয়া সমীক্ষা করা হইয়াছিল। তাঁহাদের দুই দলে বিভক্ত করিয়া, একটি দলকে ধূমপানবিরোধী পুস্তিকা দেওয়া হয়, অন্য দলকে তাহার পাশাপাশি কিছু পেশাদার পরামর্শদাতার সহিত অধিবেশনের ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হয়, এবং বলা হয়, এক বৎসরের মধ্যে সিগারেট ছাড়িতে পারিলে তাঁহাদের কিছু টাকা দেওয়া হইবে। কত টাকা, তাহা বলা হয় না। ছয় মাস পরে, যাঁহারা ইতিমধ্যেই ছাড়িতে পারিয়াছেন তাঁহাদের ২৫০ ডলার করিয়া দেওয়া হয় ও বলা হয় আরও ছয় মাস পরেও যদি দেখা যায় পুনরায় সিগারেট ধরেন নাই, তবে আরও ৫০০ ডলার পাইবেন। প্রথম ছয় মাসের মধ্যে অর্থ-প্রতিশ্রুতিদত্ত দলের প্রায় ১০% লোক ধূমপান ছাড়িতে সক্ষম হইয়াছিলেন, পুস্তিকা-প্রদত্ত দলের মাত্র ১%। এক বৎসর পরে দুই দলের ক্ষেত্রেই ইহা বাড়িয়া ১২% ও ২%-এ দাঁড়ায়। যদিও এই তর্ক করা যাইতেই পারে যে, লোকগুলি অভ্যাস ছাড়িলেন কেবল অর্থের লোভে নহে, পরামর্শের কারণেও, তবু অর্থের ব্যাপারটি প্রকটতর হইয়া দেখা দেয়। সমীক্ষার নীতিকথাটি সরকারের পক্ষে অনুসরণ করা খুবই কঠিন, কারণ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে যদি উৎকোচ দিয়া কুঅভ্যাস হইতে নিরস্ত করিতে হয়, তবে সদিচ্ছাময় দেশ দেউলিয়া হইয়া যাইবে। কিন্তু ইহাতে বুঝা যায়, একটি স্পষ্ট উদ্দীপকের সন্ধান দিলে মানুষ যত উৎসাহী হইয়া কাজ করে, সতর্ক করিলে তাহার সিকি ভাগ করে না।
শিশুরা নিজের ভাল বুঝে না, কেবল মুহূর্তের উত্তেজনাকে মূল্য দেয়, তাই তাহাদের বিভিন্ন লোভ দেখাইয়া জল ঘাঁটা হইতে বা ধুলায় গড়াগড়ি খাওয়া হইতে বিরত করিতে হয়। বলিতে হয়, ভাত খাইয়া লও, তাহা হইলে বৈকালে পার্কে লইয়া যাইব। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যিনি নিজের ফুসফুসে সম্ভাব্য অসুখ সঞ্চার করিতেছেন, ক্যানসার হইলে যাঁহার নিজের যন্ত্রণা হইবে অসহ, তাঁহাকে দৌড়পথের শেষে গাজর ঝুলাইয়া তবে আত্মসংযমে প্রণোদিত করিতে হইবে, অবিশ্বাস্য ঠেকে। কিন্তু সত্যই, জনগণ অবুঝ শিশুরই সমধর্মা। তাহাকে বলা হইল বৃক্ষ কাটিয়ো না, সে শুনিল না। বলা হইতেছে, জঞ্জাল ফেলিয়ো না, তোমারই ডেঙ্গি হইবে, সে শুনে না। হয় শাস্তির ভয় দেখাইয়া, অথবা পুরস্কারের লোভ দেখাইয়া তাহার নিকট হইতে সেই কাজ আদায় করিতে হইতেছে, যাহা তাহার নিজ গরজেই অহরহ করা প্রয়োজন। আবার যদি মানিয়া লইতে হয়, জনগণের কাণ্ডজ্ঞান বলিয়া কিছু নাই, তবে কেবল মানুষের প্রতি নহে, গণতন্ত্রের প্রতিও বিশ্বাস হারাইতে হয়। তখন জটিলতর তর্ক!
যৎকিঞ্চিৎ
বুড়ো বাবা বা মা’কে ঘরে তালাবন্ধ রেখে বেড়াতে চলে যাওয়া চমৎকার অভ্যাস। বেড়ানোটাও স্বস্তিময় হয়, খরচাও কমে, আর ফিরে এসে বুড়ো লোকটাকে যদি খিদের চোটে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়, আপদ গেল! বেঁচে থাকলেও সে মিনমিন করবে, কোনও বেগড়বাঁই দেখলেই তাকে সতর্ক করা যাবে, বেড়াতে চলে যাব কিন্তু! বাদ সাধছে শুধু কিছু প্রতিবেশী, নিজেরা বেড়াতে যেতে পারছে না বলে হিংসে! পরামর্শ: সারা পাড়া মিলে বেড়াতে যান, সব বুড়োবুড়ি এক ঘরে বন্ধ থাক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy