অশান্ত এই পৃথিবীতে এক টুকরো শান্তিপূর্ণ জায়গা কি কোথাও নেই? সদ্য ইংল্যান্ড ও আমেরিকা ঘুরে এসে এই কথা ভাবছিলাম। এক দেশে ব্রেক্সিট নিয়ে হইহই, অন্য দেশে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘ইমপিচমেন্ট’-এর তোড়জোড়।
কলকাতায় মন হাঁপিয়ে উঠেছিল। খবরের কাগজে বা টিভিতে চোখ রাখলেই দেখতে হয় ‘কাটামুণ্ড’, ‘ঝুলন্ত দেহ’, ‘গণপিটুনি’। আর সহ্য হয় না। কাশ্মীরে লকডাউন, সংসদে নানা আজব আইন। পলায়নি মনোবৃত্তি থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি হাজির হলাম লন্ডন শহরে। পৌঁছে দেখি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসা ঠিক কি না, অর্থাৎ ব্রেক্সিট নিয়ে তুমুল ঝড় উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন যে কোনও উপায়ে ব্রেক্সিট পার্লামেন্টে পাশ করাতে বদ্ধপরিকর। বিরোধী পক্ষকে কাবু করতে না পেরে তিনি পার্লামেন্টে অধিবেশন বন্ধ ঘোষণা করেছেন। ও দেশের সাহসী সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে, এই কাজ অবৈধ। অতএব অধিবেশন আবার শুরু হয়েছে। টিভি খুললেই চোখে পড়ছে, এমপি-দের তীব্র বিতর্ক। যখন লন্ডনে থাকি, তখন জার্মানি থেকে পরিবারিক পরিজনেরা দেখা করতে আসেন। এ বার প্রিয় আত্মীয়া অনিতা দেখা করতে আসা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাঁর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পাসপোর্ট। বললেন, হঠাৎ যদি ব্রেক্সিট পাশ হয়ে যায়, তা হলে তো ইংল্যান্ডে ঢুকতে দেবে না। চার দিকে একটা অনিশ্চয়তার আবহাওয়া, স্কটল্যান্ডের এক রকম মত, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের নিজস্ব আলাদা মত। অন্যান্য দেশের লোক যাঁরা বহু দিন ধরে ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন, তাঁরাও দুর্ভাবনায়—অনুপ্রবেশকারী বলে বিতাড়িত হবেন না তো?
অতলান্তিক মহাসমুদ্র পার হয়ে এ বার হাজির হলাম আমেরিকাতে। সেখানে পৌঁছে দেখি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘ইমপিচমেন্ট’ নিয়ে হুলস্থুল শুরু হয়ে গিয়েছে। ট্রাম্প তাঁর নানাবিধ খ্যাপাটে মন্তব্যের জন্য সমালোচিত হচ্ছিলেন। তবে আমেরিকার ধনী, শ্বেতকায় সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা যথেষ্ট প্রবল। ছিলাম ম্যাসাচুসেটস-এর কেমব্রিজ শহরে। এখানে মানুষজন মুক্তমনা এবং ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তবে যে কারণে ‘ইমপিচমেন্ট’-এর দাবি বেশ জোরদার হয়ে পড়েছে, সেটি অভূতপূর্ব। ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে টেলিফোন করে বলেন, তিনি যদি ডেমোক্র্যাট দলের প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করেন, তা হলেই তাঁকে প্রচুর সামরিক সাহায্য দেবেন। ভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের এ-হেন প্রস্তাব কল্পনাতীত এবং বিপজ্জনক। সম্প্রতি কেউ এক জন কথাটা ফাঁস করে দিয়েছে। এই ধরনের কথা যাঁরা ফাঁস করেন, আধুনিক ইংরেজিতে তাঁদের বলা হয় ‘হুইসল-ব্লোয়ার’। ক্রুদ্ধ ট্রাম্প লম্ফঝম্প করছেন এই ‘হুইসল-ব্লোয়ার’কে তিনি খুঁজে বার করে প্রচণ্ড শাস্তি দেবেন। সেই ব্যক্তি এখনও পর্দার আড়ালে। বিরোধী পক্ষ স্থির করল, তারা অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করবে। ইউক্রেনে আমেরিকার দু’জন রাষ্ট্রদূত সাক্ষ্য দিলেন। আমেরিকার সিকিয়োরিটির উচ্চপদস্থ অফিসার সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনিও কথাটা শুনেছেন। ফলে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রক্রিয়া যথেষ্ট গতি পেয়ে গিয়েছে। তবে ‘ইমপিচমেন্ট’ জনপ্রতিনিধি আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বর্তমান বিরোধী পক্ষ ডেমোক্র্যাট দল কাকে প্রার্থী করবে, তাই নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। ১২ জন প্রেসিডেন্ট পদের অভিলাষী এক বিতর্ক সভায় যোগ দিলেন। নির্বাচিত হলে তাঁরা কে কী ধরনের কাজ করবেন, জানালেন।
বিতর্ক শুনে আমার দু’জন মহিলা প্রার্থীকে পছন্দ হল। এক জন ম্যাসাচুসেটস-এর বর্তমান সেনেট সদস্য এলিজ়াবেথ ওয়ারেন (ছবিতে)। মহিলা বেশ ভাল বললেন। আমেরিকাতে গরিব মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার উপায় নেই। ডেমোক্র্যাটরা সকলেই হেলথ কেয়ারের ওপর জোর দিচ্ছিলেন। অপর জন কমলা হ্যারিস। কমলার মা তামিল। তিনিও বিতর্কে বেশ স্বচ্ছন্দ। এখন অবশ্য তিনি এই দৌড় থেকে সরে গিয়েছেন। বার্নি স্যান্ডার্সও ভাল বললেন। প্রাক্তন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জোরালো প্রার্থী। কিন্তু তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তাঁর পুত্র ইউক্রেনের তেল কোম্পানির বোর্ডে ছিলেন। সেই বিষয়ে তিনি খুব ভাল জবাব দিতে পারলেন না।
ইতিমধ্যে ফিরে এলাম ইংল্যান্ডে। সেখানে এখনই ব্রেক্সিট হচ্ছে না। পার্লামেন্টের নির্বাচন ডাকা হয়েছে। খবর পেয়ে জার্মানি থেকে পরমাত্মীয়া অনিতা এসে পড়লেন। আমরা যখন লন্ডনে পারিবারিক আনন্দে রয়েছি, তখন সেখানে নির্বাচনী ঝড় উঠে পড়েছে। তা হলে আর শান্তির শহর কোথায় পাব? যে দিকে তাকাই প্রবল অশান্তি। হংকং ছিল শান্ত, সুন্দর শহর। সেখানে প্রবল বিক্ষোভ চলছে। স্পেনের একাংশে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রবল বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। সিরিয়াতে যা ঘটছে, তা বলাই বাহুল্য। বলিভিয়া, চিলি, লেবানন, ইরাক— সর্বত্র তুমুল রাজনৈতিক অশান্তি চলছে। তবে আমার নিজের প্রিয় শহর কলকাতাতেই ফিরে যাই। অশান্ত এই পৃথিবীতে আমার অশান্ত শহরেই ফিরে এলাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy