Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
nobel prize

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বক্তৃতা

নোবেল বিজয়ীর তালিকায় তিনি শুধু প্রথম বাঙালি বা প্রথম ভারতীয়ই নন, তিনি প্রথম এশীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিকবিতাগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকাশ হয় ১৯১০ সালে। বছর দুয়েক পর, এই বইয়ের বেশ কিছু কবিতা এবং এর বাইরেরও অনেকগুলি কবিতার অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত হয় ইংরেজি গ্রন্থ ‘সং অফারিংস’ (Song Offerings)। এই বইয়ের জন্যই ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পান রবীন্দ্রনাথ। ওই বছর ১০ ডিসেম্বর স্টকহলমের নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি। টেলিগ্রামে লিখে পাঠানো তাঁর বার্তা সেখানে পাঠ করা হয়। তিনি লিখেছিলেন— “সুইডিশ অ্যাকাডেমির অনুভবের কাছে আমি আমার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করছি। তাঁরা দূরকে নিকট করেছেন এবং এক অপরিচিতকে ভ্রাতৃত্বে বরণ করে নিয়েছেন।” ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ সুইডেন যান। ২৬ মে স্টকহলমে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে নোবেল সম্মানকে স্মরণ এবং গ্রহণ করে তিনি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতার একাংশের অনুবাদ এখানে প্রকাশ করা হল— তাঁরই উত্তরসূরী বাঙালি অভিজিত্ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল প্রাপ্তির দিনে।সেই মুহূর্তে আমি একটি দল নিয়ে কাছাকাছি এক জঙ্গলে বেড়াতে যাচ্ছি। ডাক ও তার অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে এক জন দৌড়তে দৌড়তে এসে আমার হাতে সেই তারবার্তাটি দিয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:১৭
Share: Save:

অবশেষে আপনাদের দেশে আসতে পেরে আমি খুশি আর এই অবকাশেই আমার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে সম্মানিত করার জন্য আমি আমার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করতে চাইছি।

মনে পড়ছে সেই বিকেলবেলার কথা, যে দিন আমি আমার ইংল্যান্ডের প্রকাশকের তরফ থেকে তারবার্তা মারফত এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবরটা পাই। আমি তখন আমার বিদ্যালয় শান্তিনিকেতনে রয়েছি। আমার মনে হয়, এই বিদ্যালয়টির বিষয়ে আপনারা জ্ঞাত রয়েছেন।

সেই মুহূর্তে আমি একটি দল নিয়ে কাছাকাছি এক জঙ্গলে বেড়াতে যাচ্ছি। ডাক ও তার অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে এক জন দৌড়তে দৌড়তে এসে আমার হাতে সেই তারবার্তাটি দিয়ে যায়। আমার সঙ্গে গাড়িতে সেই সময়ে এক জন ইংরেজ পর্যটকও ছিলেন। তারবার্তাটি যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এমনটা সেই মুহূর্তে মনে হয়নি। আমি সেটিকে পকেটে পুরে রাখি। গন্তব্যে পৌঁছে সেটি পড়ব, এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার অতিথি সম্ভবত বিষয়টি জানতেন এবং তিনি আমাকে অনুরোধ করেন সেটি পড়ে ফেলতে, বলেন— এতে গুরুত্বপূর্ণ কোনও বার্তা রয়েছে। আমি তাঁর অনুরোধেই খাম খুলে বার্তাটি পড়ি।

প্রথমে নিজেরই বিশ্বাস হয়নি। মনে হয়েছিল, টেলিগ্রাফের ভাষায় কোনও গন্ডগোল রয়েছে, নয়তো আমিই সেটিকে পড়তে ভুল করছি, ভুল মানে বুঝছি। যাই হোক, ক্রমে ধাতস্থ হই, বুঝি আমি ঠিকই পড়েছি। আপনারা অনুমান করতে পারেন, আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে এই খবর কতটা আনন্দবাহী। আমাকে যা সব থেকে বেশি অভিভূত করে তা হল, এই যে এই ছেলেরা আমাকে ভালবাসে এবং তাদেরকেও আমি গভীর ভাবে ভালবাসি। এই সম্পর্ককে এই পুরস্কার এক অনন্য সম্মানে ভূষিত করল। আমার দেশবাসীর সঙ্গেও আমি এই সম্মান ভাগ করে নিতে চাই।

আরও পড়ুন: ১৯৯৮: অমর্ত্য সেনের নোবেল বক্তৃতা

সে দিন বাকি বিকেলটাও এই ভাবেই যায়। রাতে আমি ছাদে একা বসে নিজেকেই প্রশ্ন করি, পশ্চিমে আমার এই গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মানের কী কারণ থাকতে পারে? আমি সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের এক ভিন্‌জাতের মানুষ। পশ্চিমের সন্তানদের থেকে সর্ব অর্থেই আলাদা। আমার এই প্রশ্ন কোনও উচ্চমনস্কতা থেকে জাত নয়, তা প্রকৃতই আমার হৃদয়ের গহীন থেকে উঠে আসা। সেই মুহূর্তে নিজেকে খুবই তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল।

১৯২১ সালে স্টকহলমে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে রবীন্দ্রনাথ

মনে পড়ছিল, আমার লেখালিখির শুরুর সেই দিনগুলির কথা। আমি তখন নেহাতই তরুণ। আমার তখন ২৫ বছর বয়স। বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে গঙ্গাবক্ষে এক নৌকায় প্রায় নির্জনবাস করি। শরতে হিমালয় থেকে উড়ে আসা পরিযায়ী বুনো হাঁসরাই আমার একমাত্র জীবন্তসঙ্গী। সেই নির্জনতায় আমি মুক্ত দিগন্তকে অফুরান রৌদ্র-সুধার মতো পান করেছি, নদীর ছলোচ্ছল ধ্বনি আমার কানে কানে যেন প্রকৃতির নিগূঢ় রহস্যের কথা বলে গিয়েছে। এক নিরবচ্ছিন্ন নির্জন স্বপ্নে আমার দিন যায়, আমি সেই স্বপ্নকে কবিতায় রূপ দিতে থাকি।

কলকাতার মানুষজন সেই সব লেখা পত্র-পত্রিকা মারফত পড়েন। বুঝতেই পারছেন, সেই জীবন পশ্চিমের চাইতে একেবারেই আলাদা। আমার জানা নেই, আপনাদের সভ্যতার কোনও কবি তাঁর জীবনের তরুণ দিনগুলির একটা বড় অংশ এমন বিচ্ছিন্নতার মধ্যে কাটিয়েছেন কি না। আমার বিশ্বাস, পশ্চিমি বিশ্বে এ হেন বিচ্ছিন্নতার কোনও স্থানই নেই।

আরও পড়ুন: এর পরে লম্বা একটা ছুটিতে যাব: অভিজিৎ

আমার জীবন এমন ভাবেই কেটেছে। সেই সময়ে আমি আমার দেশবাসীর কাছেও অপরিচিত বলা যায়। আমার প্রদেশের বাইরে আমার নাম কেউ শুনেছেন বলেও মনে হয় না। সেই অপরিচয় নিয়ে কিন্তু আমি বেশ সুখীই ছিলাম। এই অপরিচয় আমাকে জনারণ্যের কৌতূহল থেকে রক্ষা করেছে। এবং এক সময়ে এই নির্জনতার কুহর থেকে বেরিয়ে আসার এক তাগিদ আমি অনুভব করতে শুরু করি। মনে হতে থাকে, আমার সহ-মানবদের জন্য কিছু কাজ করা প্রয়োজন। তা শুধুমাত্র আমার স্বপ্নগুলিকে সাকার করার প্রয়াস নিয়ে নয়, বরং আমার ভাবনাগুলিকে নিয়ত কিছু কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে, আমার সহযাত্রীদের কাজে আসে এমন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে।

সবার আগে আমার মাথায় এসেছিল ছোটদের পড়ানোর কথা। তার মানে এই নয় যে, আমি এই কাজে বিশেষ দক্ষতার অধিকারী। বরং এ কথা বলা যেতে পারে যে, আমি নিজে নিয়মিত শিক্ষালাভের পূর্ণ সুফলগুলি পাইনি। সেই কারণে আমি প্রথমে এই কাজ নিজের হাতে নিতে দ্বিধাগ্রস্তও ছিলাম। কিন্তু এ কথাও অনুভব করি যে, প্রকৃতির প্রতি আমার এক অকৃত্রিম ভালবাসা রয়েছে, শিশুদের প্রতিও রয়েছে। আমি এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, যেখানে মানবশিশুরা প্রকৃতির কোলে মুক্তির আনন্দ, জীবনের আনন্দ খুঁজে পায়। অল্প বয়সে আমি নিজে স্কুলে বেশ কিছু অন্তরায়ের সম্মুখীন হয়েছি। আমি জানি, বেশির ভাগ শিশুকেই এই বাধাগুলির মুখোমুখি হতে হয়। আমাকেও শিক্ষা-যন্ত্রের সেই যন্ত্রণাকে সহ্য করতে হয়েছে, যেখানে আমার মুক্তি আর জীবনের আনন্দ পেষাই হয়ে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।

আমি জানি, এই আনন্দের জন্য শিশুরা সর্বদা তৃষ্ণার্ত থাকে। আমার উদ্দেশ্য ছিল, মানব সন্তানদের কাছে এই মুক্তি আর আনন্দকে পৌঁছে দেওয়া। আমার চারপাশের কিছু বালককে আমি পড়িয়েছি, তাদের আনন্দ দিতে চেয়েছি। আমি তাদের খেলার সাথী ছিলাম। তাদের সঙ্গে আমি জীবন ভাগ করে নিয়েছি। আমি অনুভব করেছি, আমি তাদেরই এক জন, তাদের দলের সব থেকে বড় শিশু। খোলা হাওয়ায় আমি তাদের সঙ্গেই বেড়ে উঠি। শিশুদের অন্তরের আনন্দস্রোত, তাদের গান-গল্পে মেতে থাকা আকাশ-বাতাসে মুক্তির সুধারসকে আমি প্রতি দিন পান করি। প্রতি দিন সূর্যাস্তের সময়ে আমি একা বসে পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের লক্ষ করি। সন্ধ্যার নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও আমি শিশুদের কলতান স্পষ্ট শুনতে পাই। মনে হয় সেই আনন্দগান, সেই কলধ্বনি যেন গাছেদেরও। তারা যেন মাটির বুক থেকে উঠে আসা জীবন-ঝরনা, অনন্ত আকাশের দিকে মাথা তুলে আনন্দগান গেয়ে চলেছে।

একে প্রতীক হিসেবে দেখে আমি বুঝতে পারি, মানব জীবনের যাবতীয় আনন্দের অভিব্যক্তি, মানবাত্মার হৃদয়ের উৎসস্থল থেকে উঠে আসা আশার বাণী সেই অনন্ত আকাশের দিকেই ধাবিত। আমি যেন স্পষ্ট তা দেখতে পাই। বুঝতে পারি, আমরাও আসলে বড় হয়ে যাওয়া শিশু, আমাদের কলতানকে অনন্তের দিকে পাঠিয়ে চলেছি। আমি এই অনুভূতি হৃদয়ের উৎসস্থল থেকে বুঝি। এই পরিবেশ আর পরিস্থিতিই আমাকে ‘গীতাঞ্জলি’র কবিতাগুলি রচনা করতে প্রাণিত করেছে। উজ্জ্বল তারায় তারায় খচিত ভারতের আকাশের নীচে বসে মধ্যরাতে আমি তাদের গাই। এবং খুব ভোরে, এমনকি গোধূলিতেও আমি এই গানগুলি লিখি। এই গানের দল বয়ে চলে পরের দিনটির দিকে। আরও এক বার এই মহাপৃথিবীর হৃদয়দ্বারে প্রবেশের প্রেরণা লাভ করি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy