নরেন্দ্র মোদীর বিদেশ সফরে সাংবাদিকদের সহযাত্রা নিষিদ্ধ তাঁর অভিষেকের সময় থেকেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাপর্বে মোদীর মতো এত ঢক্কানিনাদ তো আর দেখিনি। প্রচারে, বিজ্ঞাপনে, কূটনৈতিক উপঢৌকনের জৌলুসে, কেতাদুরস্ত মহার্ঘ পোশাকে, অনাবাসী ভারতীয়-মহাসংযোগে। ইস্তানবুল হয়ে জাপান কাবুল গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা শিখেছি বিরল এক বিপণনের মহার্ঘ রান্না।
ব্যক্তিগত রসায়নে রাষ্ট্রনীতি কিছুটা সহজ হয় কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। কারণ আবেগ বা উষ্ণতায় নয়, দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রের সম্পর্ক তৈরি হয় দেনা-পাওনায়, পারস্পরিক জাতীয় স্বার্থের তুল্যমূল্যে। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুতা প্রদর্শনের একটি বাইরের দিকও রয়েছে— যা ঘরোয়া রাজনীতিতে কখনও ‘বিশ্বমিত্র’ কখনও শক্তিমান ভাবমূর্তি তৈরি করে ভোটব্যাঙ্কে ঢেউ তোলে; অল্পবিত্ত অথচ ভূকৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলিকে চাপে রাখা যায়।
মোদীর বিদেশনীতির চিরপরিচিত এই মডেলটি কিন্তু ধাঁধার থেকেও জটিল হয়ে উঠছে আমেরিকার দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্টের আসনে বসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষেত্রে। নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়া এক শীর্ষ পর্যায়ের ভারতীয় কূটনীতিক এই সাংবাদিককে এক বার বলেছিলেন (তখন ট্রাম্পের প্রথম দফার শেষ বেলা), “আমেরিকার এই প্রেসিডেন্ট যত কম কথা বলেন, ভারতের জন্য ততই মঙ্গল। উনি মুখ খুললেই বুঝতে হবে আমাদের বিপদ।”
কিন্তু এটা আশা করা একটু বেশি যে, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিধর মানুষটি মৌনীবাবা সেজে, হোয়াইট হাউসের হাওয়া খেয়ে কাটিয়ে দেবেন। তাঁর দ্বিতীয় দফার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্পষ্ট, ট্রাম্প রয়েছেন তাঁর পুরনো অবতারেই। তিনি ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট, রুষ্ট তুষ্ট ক্ষণে ক্ষণে! এই প্রশংসা করছেন, পরমুহূর্তে তীব্র ব্যঙ্গ করছেন। এই বলছেন ‘মহান বন্ধু’, তার পরই নির্মম পদক্ষেপের হুমকি দিচ্ছেন। বিশেষ করে মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের এই অম্লমাধুর্য যেন একটি স্থায়ী ভাষ্য হয়ে গিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতিতে।
শুধু দ্বিপাক্ষিকই তো নয়, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ‘ওভাল অফিস বিপর্যয়’ ইউরোপের পাশাপাশি ভারতকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমেরিকার এই প্রেসিডেন্ট বিদেশনীতি গড়েন সতত দেনা-পাওনায়— আন্তর্জাতিক স্থিতাবস্থার দীর্ঘমেয়াদি সুবিধার তোয়াক্কা না করে, এককালীন কেনা-বেচা, দ্রুত লাভের দিকে লক্ষ্য রেখে। নিজের লাভের জন্য অন্যের নিরাপত্তাকে খাদের ধারে ঠেলে দিতে তাঁর হাত কাঁপে না, তাতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ভিতর থেকে ধসে গেলেও (যাতে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই) ট্রাম্পের নীতিতে কিছু যায় আসে না।
গত মাসে ট্রাম্পের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর ওয়াশিংটন যাওয়াকে বিদেশ মন্ত্রক উঁচু তারে বাঁধতে চেয়ে জানিয়েছিল, শপথ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক প্রমাণ করে দিচ্ছে, হোয়াইট হাউসের অগ্রাধিকার তালিকায় নয়াদিল্লির আসন কোথায়। দেখা যাচ্ছে, তাঁর ‘প্রিয় বন্ধু’ মোদীর সঙ্গে বৈঠকের ঠিক আগে সাংবাদিক সম্মেলন করে ভারতের শুল্ক নীতির চরম সমালোচনা করছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যা একেবারেই কূটনৈতিক প্রথাবিরুদ্ধ। আলোচনার টেবিলে বসার আগেই অতিথি রাষ্ট্রনায়ককে এ ভাবে আক্রমণ করা সাম্প্রতিক অতীতে কবে ঘটেছে, তা মনে করা যাচ্ছে না। ট্রাম্প যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে মুখে বলছেন, মোদী তাঁর চেয়েও ভাল দর-কষাকষি করতে পারেন। কিন্তু সূত্র বলছে, একান্ত আলোচনায় তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমেরিকা থেকে আরও বেশি সামরিক সরঞ্জাম না কিনলে (রাশিয়ার থেকে কেনাকাটা কমিয়ে), আমেরিকার বিভিন্ন পণ্যকে ভারতের বাজারজাত করার সুবিধা না দেওয়া হলে, সাউথ ব্লকের কপালে দুঃখ আছে!
ইতিমধ্যেই ভারতে ভোটারদের ভোটমুখী করতে (অর্থাৎ, গণতন্ত্রে উৎসাহী করতে) আমেরিকা যে বড় মাপের অর্থ অনুদান দিত, তা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। বন্ধ করাটাই নয়, তার ব্যাখ্যা সাংবাদিকদের দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত রুক্ষ ভাবে। বলেছেন, “ওদের অনেক টাকা আছে। আমাদের থেকে ওরা অনেক কর নেয়। ওদের করের পরিমাণ এত বেশি বলে আমরা সে ভাবে বাণিজ্য করতে পারি না।” এর পরেই মোদীর কথা উল্লেখ করেন ট্রাম্প। চিরাচরিত ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ ঢঙে প্রথমে বলেন, “ভারত এবং তাদের প্রধানমন্ত্রীকে আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি।” আর তার পরেই জুড়ে দেন, “কিন্তু তাই বলে ভারতে ভোটের হার বৃদ্ধির জন্য ২১ মিলিয়ন ডলার?” অনুদান বাতিলের নথিতে স্বাক্ষরের পর এই মন্তব্যে স্পষ্ট, মোদীর সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’-এর জন্য একটি নয়াপয়সাও ছাড়বেন না ট্রাম্প। মনে রাখতে হবে, মোদীর সঙ্গে বৈঠকের আগেই ট্রাম্প সমাজমাধ্যমে লিখেছিলেন, “আজ বড় একটা দিন: পারস্পরিক শুল্ক আরোপ! আমেরিকাকে আবার মহান করতে হবে।”
বলিউডের পপ সঙ্গীতের একনিষ্ঠ শ্রোতা হিসাবে, একটি গান কর্ণপোকার মতো গুনগুন করছে এখন। ‘জ়িন্দগী কী ইয়েহী রীত হ্যায়/ হার কে বাদ হী জীত হ্যায়’। যাঁরা আকণ্ঠ মোদীভক্ত, যাঁরা মনে করেন এই বিশ্বের গুরুশ্রেষ্ঠ মোদী তথা ভারত, তাঁদের জন্যও ভারত-আমেরিকার সম্প্রতি প্রকাশিত তিন হাজার শব্দের দীর্ঘ যৌথ বিবৃতিতে অনেক আশার কথা রয়েছে। তাঁদের কাছে বিষয়টি এমন যে, “হ্যাঁ, কিছুটা কর ছাড়ের চাপ গিলতে হচ্ছে আমাদের ঠিকই, কিন্তু তার পরেও জয় করে নেওয়ার জন্য রয়েছে অর্ধেক আকাশ।”
ট্রাম্প কিছুটা বিরল ভাবেই প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন মোদীর সঙ্গে। একান্ত বৈঠক করেছেন, জার্নি টুগেদার নামের একটি বিশেষ ভাবে তৈরি করা বই উপহার দিয়েছেন, তাঁকে ‘বিশেষ বন্ধু’ বলেছেন, ভারত-আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য অন্তত ছ’মাস সময় দিয়েছেন। সরকারপন্থী কূটনৈতিক শিবিরের যুক্তি— কৃত্রিম মেধা, সেমি-কন্ডাক্টর, মহাকাশ প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রে সমন্বয়ে লাভবান হতে চলেছে ভারত। দীর্ঘ বিবৃতির শেষে এই ক্ষেত্রগুলিতে সহযোগিতার এমন প্রতিশ্রুতি আমেরিকার তরফ থেকে রয়েছে, যা ওয়াশিংটন অন্য কোনও মিত্র দেশের সঙ্গে বড় একটা করে না। তাঁরা তুলে ধরছেন যৌথ বিবৃতির ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদটি, যেখানে বলা হয়েছে ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দু’দেশের সরকারি এবং বেসরকারি অংশীদারি বাড়ানো হবে সেমি-কন্ডাক্টর, দুর্লভ খনিজপণ্য, ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এর ফলে উভয় দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে, গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ ব্যবস্থা বিস্তৃত হবে, জীবনদায়ী ওষুধ আয়ত্তের মধ্যে আসবে।
ভারত মহাসাগর এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের নিরাপত্তাকে মান্যতা দিয়ে বিপুল বিনিয়োগের কথাও বলা হয়েছে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর। অবৈধ অভিবাসন-সংক্রান্ত ট্রাম্পের হুমকির ‘পাল্টা’ দিতে গিয়ে মোদী বিচক্ষণতার সঙ্গেই দায় আংশিক ভাবে মেনে জানিয়েছেন, বিষয়টিতে আমেরিকারও দায়িত্ব রয়েছে। সীমান্ত টপকে, কে বা কারা বেআইনি ভাবে তাঁদের দেশে চলে এলেন, সে বিষয়ে তাঁদেরও হুঁশিয়ার থাকতে হবে। একই সঙ্গে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা যে আমেরিকার অর্থনীতিতে প্রভূত প্রভাব ফেলেন, তা আপাতত ট্রাম্পকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
শেষ কথা এই যে, শুধু আলিঙ্গনে চিঁড়ে ভেজে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক যে বাণিজ্য শুল্কের তোলপাড়ে পণ্ড হল না, তা নিশ্চিত করার জন্য আগে থেকেই কাজ সেরে গিয়েছিলেন মোদী। ‘শুল্কের রাজা’, ‘শুল্কের অপব্যবহারকারী’র মতো মধুর স্বরে দেওয়া গালিগুলিকে লঘু করতে সাম্প্রতিক বাজেটে গড় আমদানি শুল্ক ১৩ থেকে ১১ শতাংশ, এবং শীর্ষ আমদানি শুল্ক ১৫০ থেকে ৭০ শতাংশে নামানোর কথা ঘোষণা সেরেছে মোদী সরকার। বোর্বন হুইস্কি থেকে মহার্ঘ বাইকের আমদানির উপর কর কমানোয় কিছু প্রসন্ন হয়েছে হোয়াইট হাউস। যদিও এখনও অনেকটা পথ হাঁটা বাকি। কতটা শুল্ক ছাড়লে তবে প্রকৃত বন্ধু হওয়া যায়? অন্য অনেক কিছুর মতো এই প্রশ্নকে ঘিরেও আবর্তিত হবে ভারত আমেরিকার আগামী দিনের পথ চলা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)