Advertisement
০৯ নভেম্বর ২০২৪

আমাদের শুনতে দিন

মুম্বইতে ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট’-এ ভাষণ দেওয়ার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করার ‘অপরাধ’-এ বিশিষ্ট অভিনেতা অমোল পালেকরকে অসন্তোষের মুখে পড়তে হল।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

মুম্বইতে ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট’-এ ভাষণ দেওয়ার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করার ‘অপরাধ’-এ বিশিষ্ট অভিনেতা অমোল পালেকরকে অসন্তোষের মুখে পড়তে হল। তাঁকে বলা হল, যে প্রয়াত শিল্পীর বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন, তার বাইরে না যেতে। বক্তা কী বলবেন, কতখানি বলবেন সে সব নিয়ন্ত্রণের পর্যায় পর্যন্ত তা হলে আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় শাসন নেমে এসেছে। কোন বক্তা বক্তব্য পেশ করবেন, কে করতে পারবেন না, তাও ‘রাষ্ট্র’ থুড়ি রাষ্ট্রের খুল্লতাতরা ঠিক করে দিচ্ছেন। স্বমত প্রকাশ করতে না পেরে শিল্পী-সাহিত্যিকরা গুমরে মরছেন। বিচিত্র মত শুনতে না পেয়ে আমরা শ্রোতারাও বঞ্চিত হচ্ছি ভাবনার ক্যানভাসে নানা তুলির টান থেকে। মোদ্দা কথা হল বাড়ন্ত হয়ে উঠছে স্বাধীনতার রসদ— এই দেশের মানুষের চিন্তার ভাঁড়ারে।

শুধু অমোল পালেকর নন, কিছু দিন আগেই আর এক অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহকেও একই অসন্তোষের সামনে পড়তে হয়েছিল। ভুবনখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও বাদ পড়েননি। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রকে তাদের নির্মাণের ‘মূল্য’ চোকাতে হয়েছে। গায়ক শান গান গাইতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন। কবি শ্রীজাত কবিতা লেখার দাম মিটিয়েছেন ঘেরাও হয়ে। এমনটা চলছে তো চলছেই। এক জায়গায় নয়, এক অজুহাতে নয়, এক শ্রেণির মানুষের দ্বারাও নয়— তবু এই হিংস্রতার সংস্কৃতি হঠাৎই যেন দেশ জুড়ে ফুঁসে উঠেছে। একটি সাধারণ যোগ সব ক’টি ঘটনাকেই এক সুতোয় বেঁধে দিচ্ছে। তা হল, ধর্ম, রাষ্ট্র, ভাষা, সংস্কৃতি সব কিছু নিয়েই এক ধরনের অদ্ভুত উগ্রতা। ক্রমশ আমাদের দেশের একটা বড় অংশ এককে বহুর মধ্যে দেখতে ভুলে গিয়ে বহুকে এক বানাবার অস্বাস্থ্যকর প্রচেষ্টায় উন্মত্ত হয়ে উঠছে। তারা ভুলেই যাচ্ছে যে, তার মতের বাইরেও আরও অন্যান্য মত থাকতে পারে, এবং তা প্রকাশ করার অধিকারও অন্যদের আছে।

স্বকীর্তি পরিবেশন, স্বমত পোষণ এবং প্রকাশের ক্ষেত্রে এই দারুণ শৃঙ্খল যে শুধুই সমাজের গুণী মানুষজনের স্বাধীনতায় বাধা হচ্ছে, তা নয়। আমরা অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকরা, যাঁরা তাঁদের শ্রোতা বা দর্শক, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম কিংবা মতামত থেকে। প্রত্যেক মানুষের অধিকার আছে এই সময় ও এই পারিপার্শ্বিকের সমস্ত ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া দেওয়ার। সেই প্রতিক্রিয়া তিনি কোন পরিসরে, কোন বক্তব্য পেশ করে, প্রবন্ধ লিখে, গান গেয়ে ব্যক্ত করবেন, সেটা তাঁর নিজেরই ঠিক করার কথা। তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে বা শুনে আমাদের মতো বহু মানুষের নিজেদের সমৃদ্ধ করার কথা, নিজেদের মতামত তৈরি করার কথা। কাজেই এঁরা মত প্রকাশে বাধা পেলে আমাদের মত গঠনেও বাধা আসে। আমাদের স্বমতের অধিকারও বাধার সম্মুখীন হয়। যাঁরা বলার, তাঁরা বলবেন, আমরা শুনব। তার বিরুদ্ধে যাঁরা বলবেন, আমরা তাও শুনব। এই গণতান্ত্রিক দেশ দুই পক্ষের কথাই শোনার অধিকার আমাদের দিয়েছে। তা থেকে বঞ্চিত করা নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার শামিল। আমরা কাউকেই তা করতে দিতে পারি না।

গেরুয়া শাসনের এই গত কয়েক বছরে আমাদের পতাকার গেরুয়া রঙের মাহাত্ম্য মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ত্যাগ-তিতিক্ষার যে অসাধারণ পরিব্যাপ্তি আমাদের জীবনদর্শনকে সমৃদ্ধ করবে বলে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা আশা করেছিলেন, তাঁদের জন্য আজকের ক্লেদাক্ত বর্তমান কাল গেরুয়া চাদরে মোড়া হিংসা ও সঙ্কীর্ণতার উপহার নিয়ে বেপরোয়া স্পর্ধায় উপস্থিত। মাঝে মাঝে কিছু যুক্তিও হাজির হয়। কোনও লেখিকাকে এই রাজ্য তথা দেশ থেকে বিতাড়নের প্রসঙ্গ আসে। যেন ‘বাক্‌শুদ্ধতা’র ধ্বজাধারীরা তখন প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন! যেন সেই লেখিকাকে তাঁরা ক্ষমতায় এসেই ভারতের নাগরিকত্ব দিয়ে দিয়েছেন! যেন লেখিকার অভিমানকে তাঁরা আদৌ রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন না! দুর্ভাগ্য এই, যে এমন অলীক কুনাট্য রঙ্গে শুধু নায়ক বা খলনায়ক নেই, আমাদের মতো রাজা লিয়ারের চিহ্নাঙ্কিত ‘ফুল’রাও আছি এবং সময়ের স্বর শুনতে পাওয়া থেকে আমরাও বঞ্চিত হচ্ছি। এই অনধিকার কিন্তু গণতন্ত্র কাউকে দেয় না।

আমরা জানি, সীমান্তে জওয়ানরা লড়ছেন। আমরা এও জানি, তাঁদের যাপনের দৈন্যগুলিকে কিছুতেই সামনে আনা চলবে না। আমরা জানি, সবার উপরে ‘রাষ্ট্র সত্য’। কিন্তু সেই রাষ্ট্র মানে যে মানুষ, তা ভাবা চলবে না। তবু এই সব যাঁরা বলে বেড়ান, যাঁরা মানুষের চেয়ে গরুর খাতে বেশি টাকা ঢালেন, যাঁরা মহামানবের আদর্শ ভুলে ‘মূর্তি টুরিজ়ম’-এর হুজুগ তোলেন, তাঁদের কথাও বলার আর শোনার অধিকার সকলের আছে। উল্টোটা শুনবার ও বলবার অধিকারও রয়েছে।

‘ভারত রাষ্ট্র’-এর স্বনিযুক্ত অভিভাবকরা শুনে রাখুন, পেশি সকলেরই আছে। তবে তা বোধ ও বুদ্ধির চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে পারে না। কাজেই পেশি নয়, চিন্তার চর্চা হোক। মাননীয় ‘অভিভাবকগণ’, কবে আপনাদের রক্তচক্ষু মানুষের রোষের ফলে বুদ্বুদের মতো উড়ে যাবে, সেই সর্বনাশের অপেক্ষা করবেন, না সংযত হয়ে আমাদের কথা বলতে আর শুনতে দেবেন, তা আপনাদেরই সিদ্ধান্ত।

অন্য বিষয়গুলি:

Amol Palekar National Gallery of Modern Arts NGMA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE