আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট যিনি এখনও দায়িত্বভার গ্রহণ করেননি, তাঁর একটি সাম্প্রতিক বার্তা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। ভোটের আগে দীপাবলি সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী-কালীন সরকারের ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ বিষয়ে কঠিন ভর্ৎসনাবাক্য উচ্চারণ করলেন, যা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে গেল বাংলাদেশে, ভারতে ও এই দুই দেশের অভিবাসী বা ডায়াস্পোরা সমাজের মধ্যে। প্রেসিডেন্ট-প্রার্থী হিসাবে ট্রাম্প কেন হঠাৎ এমন কথা বলেছিলেন, তা বুঝতে আন্তর্জাতিক কূটনীতির বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, ভোট রাজনীতির হালচাল বুঝলেই চলে। আমেরিকায় হিন্দুত্ববাদী ডায়াস্পোরার ক্ষমতা রীতিমতো ব্যাপক ও বিপুল। এও যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত যে ট্রাম্প এই হিন্দু সমাজের অন্যতম নয়নমণি। নানা প্রবাসী হিন্দু সংগঠন এ বারে ট্রাম্পকে ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ করেছিল বলে শোনা যায়। তবে কেবল প্রবাসী হিন্দুরা নন, তাঁদের বাইরেও অনেক স্বার্থগোষ্ঠী বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে উদ্বিগ্ন, এবং সেই ঘটনাক্রমে বাইডেন সরকারের জল্পিত ভূমিকায় বিক্ষুব্ধ। ট্রাম্পের বার্তার কঠোরতা নিশ্চয়ই তাঁদেরও প্রসন্ন করেছে। ভোট-রাজনীতির বাইরে, কূটনৈতিক ভাবে বিশেষ স্বস্তি বোধ করেছে ভারত। বিভিন্ন কারণেই বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংখ্যালঘু পীড়ন নিয়ে সরব হওয়া দিল্লির পক্ষে দুরূহ। ট্রাম্পের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের দূরত্ব সর্বজনবিদিত, তার মধ্যে এই বহুলপ্রচারিত বার্তা ইউনূস-নেতৃত্বের সরকারকে বিরাট চাপে রাখছে বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ— এই পরিস্থিতিতে, আপাতত, দিল্লি কিছুটা হলেও স্বস্তিতে।
তবে কিনা, বিষয়টি কেবল রাজনীতি-কূটনীতির নয়, তার চেয়ে অনেক ব্যাপক ও গভীর দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিশেষত চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক হিন্দু ও বৌদ্ধ বিরোধী হিংসার প্রাবল্য ক্রমশই অত্যন্ত সঙ্কটসঙ্কুল হয়ে উঠছে। ঢাকার নতুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে যদিও জানানো হয়েছে যে ট্রাম্পকে এ বিষয়ে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, তবু বলতেই হয় বিশ্বময় প্রচারমাধ্যমে ইতিমধ্যেই যে সব তথ্য উঠে এসেছে, সেগুলিই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। যে কোনও রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘু পীড়ন আপত্তিকর: কিন্তু তন্মধ্যে এই উপমহাদেশে যে-হেতু প্রতিবেশী দেশসমূহের মধ্যে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু আবেগের জটিলতা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে, তাই হিংসার আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বিরাট। ভারতেও বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রতিবেশী দেশে অস্থিরতা তৈরি করেছে। এ দিক দিয়ে দেখলে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা নিয়ে এই মুহূর্তে ভারতের উদ্বেগ অত্যন্ত স্বাভাবিক। ভারত সরকারের তরফে, তাঁদের সুরক্ষার জন্য গঠনমূলক পদক্ষেপ করতে ও চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।
বস্তুত চরমপন্থী বা ইসলামি মৌলবাদী প্রভাব সে দেশে এখন তীব্র ভাবে বেড়ে চলেছে, যা সমাজমাধ্যমের হিংসাত্মক প্রচারেই স্পষ্ট। গণহিংসার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় হিংসাও বেড়ে চলেছে। সংখ্যালঘু মানুষদের হেফাজতে অমানুষিক প্রহার করা হচ্ছে, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের তুলে নিয়ে হত্যার অভিযোগে জেলে পোরা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার আদালতে প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আমুকে কেন্দ্র করে যে ঘটনা ঘটল, পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে সেই একটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। স্পষ্টতই, এ কেবল সংখ্যালঘুর প্রতি নির্যাতন নয়, সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শারীরিক ভাবে পিষ্ট করার ন্যক্কারজনক প্রবণতা। পাশাপাশি, মানসিক নির্যাতন ও সাংস্কৃতিক নিষ্পেষণের প্রভূত দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে প্রায় প্রত্যহ। সমগ্র উপমহাদেশের জন্যই এই অস্থিরতা বিপজ্জনক, সে কথা মনে রেখে অন্তর্বর্তী-কালীন ইউনূস সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করবেন, এই আশা রইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy