এক ধাক্কায় ১৪০০ শব্দ ঢুকিয়া পড়িল ইংরাজি ভাষার অন্যতম প্রামাণ্য অভিধানে। সেই তালিকায়, কিমাশ্চর্যম্, ‘ইডিয়োক্র্যাসি’ শব্দটিও রহিয়াছে। শব্দটির অর্থ তাহার নামেই স্পষ্ট। মূর্খ অথবা নির্বোধদের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকেই ইডিয়োক্র্যাসি নাম দেওয়া হইয়াছে। কোনও অর্বাচীন শব্দ তখনই অভিধানে ঠাঁই পায়, যখন সমসময়ের প্রেক্ষিতে সেই শব্দটি তাৎপর্যবাহী হইয়া উঠে। সেই নিরিখে, বর্তমান সময়ে নির্বোধতন্ত্র শব্দটির তুল্য দ্বিতীয় শব্দ খুঁজিয়া পাওয়া ভার হইবে। মানবসভ্যতার যাহা কিছু অর্জন— গণতন্ত্রের উত্তরাধিকার হইতে উদার বাণিজ্যের দুনিয়াব্যাপী পরিসর, ধর্মনিরপেক্ষতা হইতে রুচির স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার— বর্তমান সময়ের বহু রাষ্ট্রনায়কই এখন সেগুলিকে মিসিসিপি, ভোলগা বা গঙ্গার জলে ভাসাইয়া দেওয়ার পণ করিয়াছেন। তাঁহারা নিত্যনূতন প্রাচীর তুলিয়া মানুষকে আরও বিভক্ত করিতে উদ্যত। সেই প্রাচীর কখনও কখনও আক্ষরিকও বটে। তাঁহারা উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলিয়া অর্থনীতির খামতি ঢাকেন, পরিচিতির প্রশ্নে উন্নয়নের অভাব লুকাইতে চাহেন, আর বিজ্ঞাপনের প্রাবল্যে সত্যকে ভাসাইয়া লইয়া যাইতে চাহেন। ব্যক্তি হিসাবে তাঁহাদের নির্বোধ বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। রাজনৈতিক অঙ্কে কোন চালে লাভ, আর কোথায় ক্ষতি, সেই হিসাব তাঁহারা প্রত্যেকেই পুরাদস্তুর বোঝেন। তাঁহারা শুধু এই কথাটুকু বুঝিতে চাহেন না যে নিজেদের ব্যক্তিগত বা সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করিবার খেলায় তাঁহারা সমাজকে বিধ্বস্ত করিতেছেন, দেশকে বিপন্ন করিতেছেন, এবং বৃহত্তর অর্থে গোটা বিশ্বকেই ক্রমে একটি বিপজ্জনক মোড়ে টানিয়া লইয়া যাইতেছেন। বর্তমান সময়ের বহু শাসনতন্ত্র যদি নির্বোধতন্ত্র হয়, তাহা শুধুমাত্র এই কারণে।
তবে, যে জনতা যেমন, তাহার তেমনই সরকার জুটিয়া থাকে— এই কথাটি পুরাতন হইয়াছে, ফলে তাহার দামও বাড়িয়াছে বলিয়া অনুমান করা চলে। যাঁহাদের শাসনকে নির্বোধতন্ত্র বলিয়া ব্যঙ্গ করা হইতেছে, তাঁহাদের অধিকাংশই গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত। এমনও নহে যে ভোটের পূর্বে তাঁহারা অন্য কথা বলিয়াছিলেন, আর ভোটের পর ভোল পাল্টাইয়াছেন। না। আজ যে রাষ্ট্রনায়কের বক্তৃতা শুনিয়া দেশবাসী, এবং বিশ্ববাসী হাসি চাপিতে ও লজ্জা ঢাকিতে ব্যস্ত, তাঁহার ভাষণেই দেশের বহুলসংখ্যক মানুষ ফের মহান হইয়া উঠিবার স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। আর যে দেশাধিপতির কাণ্ডজ্ঞান লইয়া দিনে-রাতে প্রশ্ন উঠিতেছে, তাঁহার নির্বাচনী জনসভাগুলিতেও সেই কাণ্ডজ্ঞানের (অথবা, তাহার অভাবের) সম্যক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছিল। ঘটনা হইল, অধিকাংশ মানুষের নিকট তাহা অগ্রহণযোগ্য ঠেকে নাই, আপত্তিকর বোধ হয় নাই। অনুমান করা চলে, এখনও বহু মানুষ সেই নেতাদের মধ্যে আপত্তিকর কিছু খুঁজিয়া পাইবেন না। অতএব, এই শাসনব্যবস্থা যদি নির্বোধতন্ত্র হয়ও, তাহা শুধুমাত্র শাসকদের কারণে নহে। যে জনতা উন্নয়নের অধিক সাম্প্রদায়িক ঘৃণাকে গুরুত্বপূর্ণ বোধ করিয়াছে, যে নাগরিক ভাবিয়াছে যে ভিনদেশিদের তাড়াইতে পারিলেই সুদিন দরজায় কলিং বেল বাজাইবে, সেই জনতার এই শাসকই প্রাপ্য। উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া হইতেছে কেন, সেই ‘অপরাধ’-এ যে দেশ তাহার অতি দক্ষ প্রধানমন্ত্রীকে কোণঠাসা করিয়া ফেলে, অথবা পড়শিদের
হইতে নিষ্কৃতি পাইবার তাড়নায় যে দেশের নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ রায় দেয় বিচ্ছিন্নতার পক্ষে, সেই দেশ কোন শাসক পাইবে? বরং, বলা ভাল, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখনই সেই সুবর্ণযুগ, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা আর তাঁহাদের রাষ্ট্রনায়ক একই পথে ভাবেন, একই সুরে বলেন, একই গতিতে অগ্রসর হন। নির্বোধতন্ত্র যদি প্রতিষ্ঠা হইয়াই থাকে, তাহার দায় শুধু শাসকদের হইতে পারে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy