নরেন্দ্র মোদী।
রাজনীতির ঘূর্ণাবর্ত হইতে শান্তিনিকেতনকে রক্ষা করা প্রয়োজন... জ্ঞানচর্চা এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য, রাজনীতি নহে। এবং, রাষ্ট্র আসিয়া যাহাতে ব্যক্তির জ্ঞানপিপাসার পথ রুখিয়া না দাঁড়ায়, তাহা নিশ্চিত করিতেই হইবে।’’ শান্তিনিকেতনের পরিসরটির সহিত রাজনীতির, রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হওয়া বিধেয়, সে বিষয়ে যাঁহার মতামতের গুরুত্ব সর্বাধিক হওয়া উচিত, কথাগুলি তাঁহারই। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁহার শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী গ্রন্থে ইংরাজি ভাষায় রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি উদ্ধার করিয়াছিলেন। অনুমান করা চলে, আচার্য হিসাবে প্রথম বার বিশ্বভারতীতে আসিবার পূর্বে রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলি পড়িবার অবকাশ নরেন্দ্র মোদীর হয় নাই। বহু কষ্টে জোগাড় হওয়া টেলিপ্রম্পটার যন্ত্রেও কথাগুলি ফুটিয়া উঠে নাই। ফলে, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাঁহার প্রতিটি পদক্ষেপে রাষ্ট্র আরও এক ধাপ করিয়া বিশ্বভারতীতে ঢুকিল, ভাষণের প্রতিটি শব্দে রাজনীতি অতিক্রম করিল প্রতিষ্ঠাতার নিষেধের বে়ড়া। সমাবর্তন অনুষ্ঠানটির চরিত্র ঠিক কেমন হওয়া উচিত, তাহার লিখিত বিধি নাই। কিন্তু, ঐতিহ্য বিস্মৃত না হইলে সেই অনুষ্ঠানের কাম্য রূপটি কল্পনা করিতে কষ্ট হয় না। শুক্রবারের অনুষ্ঠান সেই কাম্য রূপের বিপ্রতীপে অবস্থান করিল। ভাবিয়া দেখিলে, টেলিপ্রম্পটার যন্ত্রটি যে বিপ্রতীপ অবস্থানেরই রূপক। যে অঙ্গনে আচার্যের সহিত শিক্ষার্থীদের প্রাণের আলাপ হইবার কথা, সেখানে এই যন্ত্রটি কি বেমানান নহে? সমাবর্তন অনুষ্ঠানটিতে শেষ অবধি আর বিশ্বভারতী থাকিল না, ছাত্ররাও নহে, শিক্ষাও নহে— থাকিলেন শুধু নরেন্দ্র মোদী। তাঁহার আর পাঁচটি অনুষ্ঠানের ন্যায়।
বেদগানের সময় সিটি পড়িল, ‘মোদী, মোদী’ ধ্বনি উঠিল, ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান শোনা গেল, করতালির শব্দে স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দের দীক্ষান্ত-ভাষণ থামাইয়া দেওয়ার চেষ্টা করিল এক দল দর্শক। তাহারা অনাহূত নহে— সরকারি আমন্ত্রণপত্র ব্যতীত এই অনুষ্ঠানে কাহারও প্রবেশাধিকার ছিল না। তাহারা অপরিচিতও নহে। তাহারাই নরেন্দ্র মোদীর সভার শ্রোতা, যাহারা মোদী ভিন্ন আর কাহারও কথা শুনিতে নারাজ, আর কোনও আনুষ্ঠানিকতাকে সময় দিতে নারাজ। তাহারা মোদীকে দেখিতে আসিয়াছিল। মোদী তাহাদের দেখা দিলেন। সরকারি প্রকল্পের কথা বলিলেন, বিজেপির কর্মসূচির কথাও ছুঁইয়া গেলেন। তাঁহার বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে বিশ্বভারতী ছিল, রবীন্দ্রনাথও ছিলেন— অস্বীকার করিবার উপায় নাই— কিন্তু, তাহা নিতান্তই বুড়ি ছোঁয়া। তাঁহার উপস্থিতিতে, বক্তৃতায় ছিলেন তিনি। যেমন আর পাঁচটি বক্তৃতায় থাকেন। তাঁহার নামে জয়ধ্বনি করা দর্শকদের তিনি তিরস্কার করেন নাই, চুপ করান নাই। তিনি এই জয়ধ্বনিতেই অভ্যস্ত। তাঁহার নিকট সম্ভবত অন্য জনসভার সহিত এই অনুষ্ঠানের ফারাক ছিল না। তবে, দর্শকরা অন্তত অনুষ্ঠানের গুরুত্বের কথা স্মরণে রাখিতে পারিতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে মোদী চিরকালই আপন উচ্চতায় মহিমময়। চার বৎসরে সম্ভবত এমন কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি যান নাই, যেখানে স্থানের মহিমা তাঁহাকে ছাপাইয়া উঠিতে পারিয়াছে। বিশ্বভারতীর সমাবর্তনের মতোই প্রতিটি অনুষ্ঠানই ‘নরেন্দ্র মোদীর সভা’য় পরিণত হইয়াছে। কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে তিনি বস্তুত বেমানান, তাহা জানেন বলিয়াই কি মোদী মানসিক নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন? সে কারণেই কি নিজেকে অনুষ্ঠানের উপলক্ষের, অথবা গোটা প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহেন? প্রধানমন্ত্রী এক বার জওহরলাল নেহরুকে স্মরণ করিতে পারেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিসরে নিজেকে কী ভাবে পেশ করিতে হয়, প্রকৃত বিনয় কী ভাবে নিজের সম্মান বাড়ায়, শিখিয়া লইতে দোষ কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy