Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
প্রস্তুতিপর্বে কে কোথায়
West Bengal Municipal Election 2020

পুরভোটের সূচনা লগ্নেই উঁকি দিচ্ছে ঝুলির বিড়ালেরা

যেটুকু আভাস মিলছে, তাতে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ রাজ্যে পুরভোট শুরু হতে পারে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:৩৩
Share: Save:

যেটুকু আভাস মিলছে, তাতে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ রাজ্যে পুরভোট শুরু হতে পারে। প্রথম ধাপেই কলকাতার ভোট হওয়ার কথা। একই সঙ্গে হাওড়া, শিলিগুড়ির মতো কয়েকটি কর্পোরেশনে ভোট করা যায় কি না, ভাবনায় আছে তা-ও। বিভিন্ন কর্পোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটি মিলিয়ে মোট ১২৬টি পুর-এলাকার ভোট প্রতীক্ষিত। যদি পর পর তা হয়, তবে ব্যাপকতার দিক থেকে তাকে মিনি বিধানসভা নির্বাচন বলা যেতে পারে। এর থেকে জনমতের খানিকটা আঁচ নিশ্চয় মিলবে।

তবে ভোট যখনই হোক, দলগুলি তো আর সেই অপেক্ষায় বসে থাকতে পারে না। প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে সবাই। এবং সূচনা লগ্নেই সামনে এসে পড়ছে বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা। উঁকি দিচ্ছে ঝুলির বিড়ালেরা। মিলছে কিছু বিষের উপাদানও।

বিজেপি থেকে শুরু করা যাক। এই দল এখন রাজ্যে প্রধান বিরোধী শক্তি। যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নিজেদের শক্তি সংহত করার হাতিয়ার বলে মনে করে। হিন্দু-মুসলিম ভোট বিভাজন তাদের পরিকল্পনার মূল অঙ্গ। গত লোকসভা ভোটেও এর প্রমাণ মিলেছে। সর্বত্র না হলেও বেশ কয়েকটি জায়গায় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ভোট হয়েছে এবং তাতে ‘লাভবান’ বিজেপি।

তবে লোকসভায় ১৮টি আসন দখল করে বিজেপি রাজ্যে যতটা হম্বিতম্বি করছিল, গত কয়েক মাসে তা দৃশ্যতই বেশ স্তিমিত বলে মনে হয়। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যে কয়েকটি বিধানসভা উপনির্বাচনেও তাদের জনসমর্থন কমার লক্ষণ স্পষ্ট হয়েছে।

অন্য দিকে নাগরিকত্ব আন্দোলন ঘিরে দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং এই রাজ্যে শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই আন্দোলনে যে রকম অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন, সেটাও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দলের উপর কম চাপ নয়। অবস্থার সুযোগ নিতে মমতা যে স্থানীয় বিষয়গুলিকে ছাপিয়ে নাগরিকত্বের ‘সঙ্কট’কেই পুরভোটেরও মূল অভিমুখ করতে চাইবেন, তা হিসেবের বাইরে নয়।

এই দুইয়ের টানাপড়েনে বিজেপি এ বার কোন পথে যাবে? নজর ঘোরাতে স্থানীয় বিষয়কে প্রাধান্য দেবে? দল বলছে, তারা এ বার হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে পাড়ায় পাড়ায় মানুষের সমস্যা ও অভিযোগ জানবে এবং পুরসভা ভিত্তিক ইস্তাহার বার করে সমাধানের পথ দেখাবে। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে, ‘দিদিকে বলো’-র পাল্টা চালে এমন একটি ভাবনা কার্যকর করতে পুরনির্বাচনে ১২৬টি ইস্তাহার বার করবে বিজেপি! কিন্তু সেখানে জল-আলো-রাস্তাই কি শেষ কথা বলবে?

প্রশ্নটি জরুরি। কারণ এখানেই ওত পেতে রয়েছে তাদের আসল রাজনীতি। যা নিছক জল-জঞ্জাল-আলোতে আটকে থাকে না। বরং অন্ধকারের পথ খুলে দিতে চায়। তার প্রমাণ বিজেপির এক জাঁদরেল রাজ্যনেতা সায়ন্তন বসুর বক্তব্য। রাখঢাক না করেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল রাজত্বে কলকাতাকে কী ভাবে ‘লাহৌর’ বানানো হয়েছে, তাঁরা সেটা তুলে ধরবেন! এটা কিন্তু কোনও ইঙ্গিত নয়। সুস্পষ্ট ঘোষণা। যাতে বোঝা যায়, ধর্মীয় মেরুকরণের ভোট করাই তাঁদের আসল লক্ষ্য।

বস্তুত, ফিরহাদ হাকিম যে দিন কলকাতার মেয়র পদে বসেন, সে দিন থেকেই বিজেপি এই ‘ছুরি’তে শান দিচ্ছে। কারণ, এর আগে কলকাতায় মেয়র পদে কোনও মুসলিম বসেননি। কিন্তু মেয়র মুসলিম হলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়, সেটাই বা কোথায় লেখা আছে? মুখ্যমন্ত্রী মমতা তো সে দিক থেকে একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপের নজির গড়েছেন। সর্বোপরি ফিরহাদ সম্পর্কে অন্য যা-ই বলা হোক, তিনি উগ্র সাম্প্রদায়িক এবং মেয়র হয়ে তিনি অ-মুসলিম অর্থাৎ হিন্দুদের শহরছাড়া করে দিচ্ছেন, এমন জঘন্য ‘তথ্য’ কলকাতার সচেতন সাধারণ নাগরিকদের এক জনও বিশ্বাস করেন বলে মনে করি না।

তথাপি পুরভোটের বাজারে বিজেপি এই ভাবেই একটি সংবেদনশীল প্রসঙ্গ তুলে বিষের বাতাস বইয়ে দিতে চায়। কারণ, তারা বিশ্বাস করে, নাগরিকত্ব আন্দোলনের মোকাবিলায় যদি কলকাতার পুরভোটে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এই তাস খেলা যায়, তার ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে। প্রচার শুরুর আদি পর্বে সেই সলতে পাকানোর কাজ তারা শুরু করে দিল।

সাধারণ ভাবে পুরভোটের ময়দানে বিজেপির অবস্থান এখন পর্যন্ত খুব স্বস্তিকর বলা যাবে না। অন্য পুরসভাগুলি দূরের কথা, রাজনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কলকাতার জন্যও তাদের কোনও মেয়র-মুখ নেই। বিষয়টি যতই তত্ত্বের প্রসাধনে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, চিঁড়ে তাতে ভেজানো কঠিন।

প্রধান বিরোধী দল ক্ষমতায় গেলে কার হাতে দায়িত্ব যাবে, এটা মানুষ সর্বদা জানতে চায়। সেখান থেকে সমর্থনেরও একটা রাস্তা খোলে। সকল স্তরের ভোটেই এটা প্রযোজ্য। অনেক সময় একাধিক মুখকে সামনে রেখেও ভোট করা হয়। আসলে মুখ প্রয়োজন। বিজেপি কলকাতার মেয়র পদে কাউকে তুলে ধরতে ব্যর্থ।

চেষ্টা হয়েছিল শোভন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। মেয়র পদ ছাড়ার পরে তৃণমূলের শোভন যে দিন বিজেপির পতাকা হাতে নিলেন, সে দিন থেকেই এটা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে চাউর হয়ে গিয়েছিল, পরবর্তী পুরনির্বাচনে বিজেপি তাঁকেই তুলে ধরবে। কোথাকার জল কত দূর গড়িয়েছে, সেই চর্বিতচর্বণে যাওয়া নিষ্প্রয়োজন। শোভনের অবস্থান এই মুহূর্তে কোথায়, সেটাও ধোঁয়াশা।

কিন্তু ভোটপর্বের আদি কাণ্ডেই তিনি আবার যে ভাবে হোর্ডিংয়ে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন, সেটি বেশ চমকপ্রদ। হঠাৎ দেখা যাচ্ছে, পদ্মফুল আঁকা হোর্ডিংয়ে শোভনকে কলকাতা পুরসভার ‘বেহাল’ দশা সামলাতে নেমে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন এক দল ‘নাগরিক’। তাঁরা যে-ই হোন, পরিচয় প্রকাশে অনীহা আছে তাঁদের। তবে ভোটের আগে জল ঘুলিয়ে দেওয়ার কাজে তাঁদের আগ্রহ বেশ পরিষ্কার। আর সেই জলে মাছ ধরার অছিলায় দিলীপ ঘোষের মতো বিজেপি নেতাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, হোর্ডিং যে-ই দিক, শোভন পুরভোটে সক্রিয় হতে চাইলে ব্যাপারটা মন্দ হবে না!

বিরোধী পরিসরে সিপিএম এবং কংগ্রেস এখন যৌথ উদ্যোগের শরিক। তবু জানা যাচ্ছে, আসন ভাগাভাগির অঙ্ক মেনে খাস কলকাতাতেই প্রার্থীর আকাল! কংগ্রেস নাকি উপযুক্ত সংখ্যক প্রার্থী পাচ্ছে না। আবার বেশি প্রার্থী দিতে হলে চাপে পড়ে যাবে সিপিএম তথা বাম শিবিরও। ছবিটি তাদের নড়বড়ে অবস্থা বোঝার পক্ষে যথেষ্ট।

সব শেষে তৃণমূল। শুধু কলকাতা নয়, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে তারা সামগ্রিক ভাবেই এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু চোরাবালিতে পা ডোবার ঝুঁকি তারা টের পেয়েছে লোকসভা নির্বাচনে। বিজেপি নয়-নয় করে ১৮টি আসন পেয়ে যাওয়ার পরে পর্যালোচনা করে তৃণমূল নেতৃত্ব বুঝেছেন পুরসভা-পঞ্চায়েতের মতো নিচুতলায় দলের প্রতিনিধি ও নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কত তীব্র। তার মোকাবিলাতেই ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি। তার মোকাবিলাতেই ‘কাটমানি’র বিরুদ্ধে মমতার প্রকাশ্য বিস্ফোরণ।

পুরনির্বাচনে নাগরিকত্ব বড় বিষয় হয়ে উঠবে, না কি পাড়ার নর্দমা সাফাই, সে প্রশ্ন সামনে আছে ঠিকই। কিন্তু যাঁদের সাদা জামায় ইতিমধ্যেই কাদার ছিটে লেগে গিয়েছে, তাঁদের কে কতটা পা রাখার জায়গা পাচ্ছেন, দল তাঁদের ফের প্রার্থী করছে কি না— সেগুলিও অবশ্যই সাধারণ মানুষের নজরে থাকবে। এ বার যদি দেখা যায়, শাসক শিবির যতটা গর্জাল ততটা বর্ষাল না, তা হলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। বিরোধীরাও তখন হাতে একটি অস্ত্র পেয়ে যাবেন। সে ক্ষেত্রে প্রশস্ত হবে তৃণমূলের ‘আত্মহনন’-এর পথ। বিজেপির নাগরিকত্ব-চাপ কিংবা বাম-কংগ্রেসের নড়বড়ে অবস্থার তুলনায় এটি কম কিছু হবে না।

কত দূর কী করা হবে, মমতার দল আপাতত সেই সিদ্ধান্তের সন্ধিক্ষণে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy