কাশী থেকে ট্রেনে চেপে কলকাতা আসার পথে ব্রহ্মা, বিষ্ণুকেও মুঘলসরাই স্টেশন পার হতে হল। কাশীতে শিব এবং অন্নপূর্ণার আশ্রয়ে ওঁরা কয়েক দিন সুখেই ছিলেন। শুধু এক দিন গোলমাল পাকিয়েছিলেন পিতামহ ব্রহ্মা। তিনি ‘সুরধুনী, এসো মা, কমণ্ডলুতে এসো’ বলে ঘাটে গিয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। এক বাঙালি মহিলা বলেছিলেন ‘মিনসে পাগল।’ অন্য জনের মন্তব্য ছিল, ‘‘না, মিনসেটা নিঃসন্দেহে বাঙাল। নইলে গঙ্গা গঙ্গা বলে হাপুস নয়নে কেঁদে মরে?’’ শেষে ভগবতী এক দিন তাঁর ঠাকুরপো বিষ্ণুকে গঙ্গার গল্পটা ফাঁস করে দিলেন, ‘‘আগে আমাদের দু’সতীনে ঝগড়া হত, এখন সে সব আর ভাল দেখায় না। বললাম, আয় বোন, দু’জনে ভাব করে মিলেমিশে থাকি। প্রত্যহ আমাকে ছত্রিশ জেতের জন্য রাঁধতে হয়, একা আর পেরে উঠিনে। তুই থাকলে, হলো তুই একদিন রাঁধলি, আমি আর এক দিন। কিছুতেই শুনলে না, অহঙ্কারে উত্তরবাহিনী হয়ে চলে গেল। যেমন কথা শোনেননি, তেমনি এখন মরছেন, ইংরেজরা জাহাজ আর স্টিমার বহিয়ে বহিয়ে কোমর ভেঙে দিচ্চে।’’
১৮৮৬ সালে দেবী সুরধুনীর যন্ত্রণার এই কাহিনি নিয়ে যখন দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্যে আগমন’ বই হয়ে ছেপে বেরোচ্ছে, তখনও মুঘলসরাই স্টেশন ছিল। কিন্তু মুঘলসরাই স্টেশন থেকে সরাসরি মালব্য ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেনে কাশী আসা যেত না। বিন্ধ্যাচল, চুনার হয়ে ট্রেন যমুনার ব্রিজ পেরিয়ে চলে যেত ইলাহাবাদ।
দুর্গাচরণের বই লেখার ত্রিশ বছর আগে দেশে দূরপাল্লার ট্রেন ছিল না, মুঘলসরাইও ছিল না। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ লান্সার বাহিনীর পাহারায় দিল্লি থেকে পালকি ও মোষের গাড়ি চড়িয়ে ইলাহাবাদে নিয়ে আসা হয়েছিল হাই-প্রোফাইল এক বন্দিকে। ইলাহাবাদেই লান্সারেরা জেনেছিল, শেষ মুঘল সম্রাটকে জাহাজে চাপিয়ে ডায়মন্ড হারবার হয়ে নিয়ে যেতে হবে রেঙ্গুন। এই সময়েই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ হিমালয় থেকে ফিরছেন। গোলযোগে তিনিও ইলাহাবাদে আটকে গেলেন, স্টিমারে কলকাতায় ফিরতে হল। ব্রিটিশের তৈরি রেল-যোগাযোগই মুঘলসরাই শহরের প্রাণভোমরা।
শহরটা সে অর্থে অনামা। কখনও তার নাম মুঘলচক, কখনও বা মঙ্গলপুর। দুর্গাচরণের বই বেরনোর মাত্র তিন বছর আগে, ১৮৮৩ সালে তৈরি হয় জংশন স্টেশন। ব্রিটিশরা নাম দিল মুঘলসরাই। নরেন্দ্র মোদী, যোগী আদিত্যনাথেরা অত্যুৎসাহে খেয়াল রাখেন না, মুঘলসরাই নামটা কোনও মুঘল বাদশাহের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। ওটি ব্রিটিশ শাসকদের দেওয়া নাম।
ব্রিটিশ আমলে গোড়ার দিকে মুম্বই-ঠানে, কলকাতা-হুগলি ইত্যাদি ছোট ছোট দূরত্বে রেললাইন তৈরি হয়েছে। কিন্তু তামাম ভারতকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে কী ভাবে বাঁধা যাবে? কলকাতার সঙ্গে দিল্লি, ইলাহাবাদ, লাহৌরকে এক লাইনে বাঁধার চেষ্টা হচ্ছিল অনেক দিন থেকেই। ১৮৬২ সালে তৈরি হল পটনা-মুঘলসরাই ডিভিশন। যোগী আদিত্যনাথ জেনে রাখতে পারেন, রাজধানী কলকাতার সঙ্গে বাকি ভারতের যোগাযোগ স্থাপনের সুবিধার জন্যই মুঘলসরাই। ১৮৬৫ সালে ইলাহাবাদে যমুনার ওপর তৈরি হল রেলসেতু, তখন কলকাতা, পটনা থেকে বহু লোক ট্রেনে সরাসরি প্রয়াগের মাঘমেলায় যায়। সুতরাং গায়ের জোরে মুঘলসরাইয়ের নাম বদলে আজ দীনদয়াল করতে গেলে বাংলার মতামতটাও জেনে নেওয়া দরকার ছিল।
সরাই মানে কী? চলমান জীবনের এক আশ্রয়, সেখান থেকে নানা দিকে বেরিয়ে পড়া যায়। ইলাহাবাদের রেলসেতু বেয়ে দিল্লি-কলকাতা সরাসরি যোগ হওযার কয়েক বছর পরেই তৈরি হল মুঘলসরাই-লাহৌর লাইন। তারও কয়েক বছর পর, ১৮৮৭ সালে গঙ্গার ওপর ডাফরিন ব্রিজ, মুঘলসরাই জংশন ছেড়ে ট্রেন ওই সেতু পেরিয়ে গেলেই বারাণসী। ‘অপরাজিত’ ছবির প্রথম দৃশ্যে নিশ্চিন্দিপুরের বালক অপু মা-বাবার সঙ্গে ওই ব্রিজ পেরিয়েই পৌঁছে যাবে সেখানে।
তাই মুঘলসরাই শুধু যোগী-রাজ্যের নিছক এক জংশন নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ওতপ্রোত জড়িয়ে। রানি রাসমণির জামাই মথুরবাবু ১৮৬৮ সালে ঠাকুর রামকৃষ্ণকে তীর্থভ্রমণে নিয়ে যাচ্ছেন। দেওঘর থেকে সরাসরি কাশী। কাশীর কাছে কোথাও গাড়ি থেকে নেমেছেন রামকৃষ্ণ ও তাঁর ভাগ্নে হৃদয়। কিন্তু আর উঠতে পারলেন না, তাঁদের না নিয়েই ট্রেন ছেড়ে দিল। পরে রাজেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ভদ্রলোক তাঁদের নিজের গাড়িতে কাশী পৌঁছে দেন। তখনও ব্রিজ হয়নি, ফলে চুনার, বিন্ধ্যাচল, সিকরোল হয়ে কাশী যেতে হয়। আবার, ১৯১২ সালে দুর্গাপুজোর পর নভেম্বর মাসে কাশী আসছেন শ্রীমা সারদা দেবী। তিনি অবশ্যই মুঘলসরাই থেকে ডাফরিন ব্রিজ পেরোচ্ছেন। আরও পরে, পঞ্চাশের দশকে অমৃতকুম্ভের পথে এই মুঘলসরাই জংশন ছাড়িয়েই ভিড়ে-ঠাসা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে কালকূটের সঙ্গে আলাপ হবে খঞ্জ বৈরাগী বলরামের। ‘পুব আকাশের কোল ঘেঁষে দেখা দিয়েছে বিন্ধ্যাচলের উঁচুনীচু মাথা।’ বাঙালি জানে, মুঘলসরাই ছাড়িয়ে বম্বে মেল ওই চুনার, বিন্ধ্যাচল বেয়েই প্রয়াগের পথে পাড়ি দেয়।
চুনার পেরিয়ে এই মুঘলসরাই-কানপুর লাইন বেয়েই কলকাতা-দিল্লি মেন লাইন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করেছিল এই চুনার দুর্গ, বারাণসীর রাজা চৈৎ সিংহের সঙ্গে ঝামেলার সময় এখানেই তাঁবু ফেলেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তারও আগে, মুঘল আমলে ছিলেন শের শাহ সুরি। মুঘল সম্রাট হুমায়ুন চার মাস ধরে অবরোধ করে রাখেন এই চুনার দুর্গ। শের শাহকে তাঁর প্রস্তাব: তুমি বাংলাটা আমাদের, মুঘলদের ছেড়ে দাও। বিনিময়ে চুনার আর জৌনপুর দুর্গ দখলের চেষ্টা আমি করব না। শের শাহ বেগতিক দেখে রাজি হলেন। তার পর হুমায়ুন বাংলার দিকে এগোতেই চুক্তি ভঙ্গ করে এগিয়ে গেলেন আগ্রার দিকে। পরবর্তী কয়েক বছর হুমায়ুন পলাতক, শের শাহই সম্রাট। চুনার দুর্গে বাংলার অধিপতি শের শাহকে তাড়া করার সময় এই হুমায়ুনের বাহিনী ডেরা ফেলেছিল এই ছোট্ট শহরে, তাই নাম মুঘলচক কিংবা মুঘলসরাই। জংশন তৈরির সময় ঠাঁই পেল সরাই নামটাই।
রেলরাস্তাই এই শহরের অন্যতম অভিজ্ঞান। এক সময় এশিয়ার বৃহত্তম মার্শালিং ইয়ার্ড, আজও প্রতিদিন অন্তত ২৫০ যাত্রিবাহী ট্রেন ও ২৫০ মালগাড়ি পাস করে এই লাইনে। শহরের পাশে ছন্দৌসি কয়লাবাজার সব সময় ব্যস্ত। ধানবাদ, আসানসোল, সিঙ্গরৌলি থেকে ফি বছরে ৩০ লক্ষ টন কয়লা ছন্দৌসির বাজারে হাতবদল হয়।
কয়লা-মাফিয়া আছে, নেই সাম্প্রদায়িকতা। কসবমহল্লা, পটেলনগরে হিন্দু-মুসলিম সবাই একত্র নির্বিবাদে বাস করেন। মন্দিরের পাশাপাশি মসজিদ ও পুরনো গির্জার সমাহার। বছর দশেক আগে বারাণসীর সংকটমোচন মন্দিরে বিস্ফোরণের সময়েও মুঘলসরাই ছিল শান্তিতে। একটা পটকাও ফাটেনি।
স্টেশনের অদূরে ‘আদর্শ বস্তু ভাণ্ডার’ নামে এক মুদির দোকান। ১৯৬৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে এই দোকানের মালিক গুরুবক্স কাপাহিকে ঘুম থেকে টেনে তুলেছিল আরপিএফ-এর এক কনস্টেবল: লাইনে একটা লাশ। শুনলাম, আপনি আইডেন্টিফাই করতে পারবেন।
আরএসএস-এর সদস্য কাপাহি ক’বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতি আউড়েছিলেন, ‘পুলিশকে বলেছিলাম, এ ভাবে মেঝেতে ওঁকে ফেলে রাখতে পারেন না। গুরুজি (আরএসএস প্রধান গুরু গোলওয়ালকর) তখন জৌনপুরে, ওঁকে ফোন করে বডি বারাণসীর সিভিল লাইনস-এ নিয়ে যাওয়া হল। গুরুজি দীনদয়ালজির মৃত শরীরের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে একটাই কথা বলতে পেরেছিলেন। ‘‘কী ভাবে হল, দীনদয়াল?’’ তার পর তো ওঁরও শরীর ভেঙে গেল।… বিকেলে সরকারি উড়ানে দীনদয়ালজির মরদেহ দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হল।’
ট্রাজেডি এখানেই। গত বছর, সুরেশ প্রভুর আমলে এক পরিসংখ্যান জানিয়েছিল, ভারতের সবচেয়ে আবর্জনা ও জঞ্জালে ভর্তি নোংরা স্টেশনটির নাম মুঘলসরাই। দীনদয়ালের শতবর্ষে, তাঁর মন্ত্রশিষ্য ও স্বচ্ছ ভারতের স্রষ্টা এই পূতিগন্ধময় স্টেশনটির নাম রাখতে চলেছেন দীনদয়ালের নামে, ইতিহাস পালটে দিয়ে, এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি আর কীই বা হতে পারে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy