Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

আশ্চর্য নালিশ

কিছু দিন পূর্বে ‘অ্যারাইভাল’ নামক এক কল্পবিজ্ঞান নির্ভর ছবিতে, এক জননী ভিনগ্রহের প্রাণী কর্তৃক ভবিষ্যদর্শনের ক্ষমতা প্রাপ্ত হন এবং ভবিষ্যৎ জানিয়াও এমন সন্তানের জন্ম দেন, যে তরুণী-বয়সে মারণরোগে আক্রান্ত হইবে।

এই সেই অদ্ভুত দাবি করা যুবক।

এই সেই অদ্ভুত দাবি করা যুবক।

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৪৫
Share: Save:

মুম্বইয়ের এক ২৭ বর্ষীয় যুবক পরিকল্পনা করিতেছেন, পিতামাতার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করিবেন, কারণ তাঁহারা তাঁহাকে জন্ম দিয়াছেন, সম্মতি না লইয়াই। অতএব সন্তানকে আজীবন প্রতিপালনের দায়িত্ব তাঁহারা লইতে বাধ্য। নিজের ইচ্ছায় জন্ম লই নাই, ফলে এই পৃথিবীতে আসিয়া আমি যুদ্ধবিগ্রহ, পীড়া, বিষাদ, যানজট সহিতে বাধ্য থাকিব কেন?— ইহা হইল অভিযোগের মূল সুর। অবশ্য তাহার সহিত রহিয়াছে আর এক প্রশ্ন: আমায় কাজ করিতে হইবে কেন? ফেসবুকে যুবককে লইয়া রঙ্গ-রসিকতা নিন্দামন্দ চলিতেছে। তাঁহাকে অনেকেই বলিয়াছেন অলস, কর্মবিমুখ। যুবকের মাতা ফেসবুকে লিখিয়াছেন, তাঁহারা সন্তানের সাহসের প্রশংসা করেন, কারণ সন্তান জানেন যে পিতামাতা উভয়েই আইনজীবী, অথচ এই মামলা লড়িবেন। মাতা যোগ করিয়াছেন, কী প্রক্রিয়ায় জন্ম দিবার পূর্বে সন্তানের অনুমতি লইতে হয়, জানিলে তাঁহারা বাধিত হইবেন। যুবক ব্যাখ্যা দিয়াছেন, সম্মতি ব্যতিরেকেই যাহাকে ধরাধামে আনিলে, তাহার ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব স্বত-ই তোমার স্কন্ধে অর্পিত হইল। যুবকটি antinatalist, ‘অজন্মবাদী’, অর্থাৎ যিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের মানুষকে জন্ম দেওয়া উচিত নহে, কারণ এই কষ্টময় বিশ্বে আরও একটি প্রাণীকে আনয়নের অর্থ তাহাকে শাস্তিদান। যুবক আরও বলিয়াছেন, মানুষ প্রজননক্রিয়ায় রত হয় নিজ আনন্দের জন্য, তাহার এই ক্রিয়ার উৎস হইল নিজ কামজ আকাঙ্ক্ষা, ফল হইল সন্তান উৎপাদন। নিজ লালসা পূর্ণ করিবার জন্য যে ক্রিয়া, তাহার ফলের পূর্ণ দায়িত্বও কি আকাঙ্ক্ষাকারীর নহে? কেহ এই মতকে সমর্থন জানাইয়া ফেসবুকে লিখিয়াছেন, অনেকেই সন্তান চাহেন বিনোদনের জন্য, কেহ সন্তান চাহেন শেষ বয়সে দেখাশোনা করিবার লোক পাইবার জন্য। অর্থাৎ সন্তান আর কিছুই নহে, আনন্দের ক্রীড়নক বা বিমা। তাই সন্তানোৎপাদন মহৎ নহে।

কিছু দিন পূর্বে ‘অ্যারাইভাল’ নামক এক কল্পবিজ্ঞান নির্ভর ছবিতে, এক জননী ভিনগ্রহের প্রাণী কর্তৃক ভবিষ্যদর্শনের ক্ষমতা প্রাপ্ত হন এবং ভবিষ্যৎ জানিয়াও এমন সন্তানের জন্ম দেন, যে তরুণী-বয়সে মারণরোগে আক্রান্ত হইবে। ইহা জানিতে পারিয়া (অর্থাৎ মহিলা পূর্বেই জানিতেন কী হইতে চলিয়াছে, তবু এই সিদ্ধান্ত লইয়াছেন) স্বামী তাঁহাকে ছাড়িয়া যান এবং এক সময় সন্তানও হাসপাতালে যন্ত্রণাময় রোগের সহিত জুঝিতে জুঝিতে বলে, সে মাতাকে ঘৃণা করে। কোনও দর্শক ভাবিতে পারেন, মেয়েটি কষ্ট পাইবে ও এত কম বয়সে মরিয়া যাইবে জানিয়া তাহাকে পৃথিবীতে আনিবার অর্থ তাহাকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণাদীর্ণ জীবনে দণ্ডিত করা। কেহ বলিতে পারেন, কোনও রূপ জীবনের আস্বাদ না পাইবার অপেক্ষা কিছু বৎসর আনন্দে জীবিত থাকা কি অধিক অভিপ্রেত নহে? মেয়েটি আদৌ না জন্মাইলে, সে তো কখনওই প্রাণের আনন্দ পাইত না। মুম্বইয়ের যুবকটির অভিযোগও এই নৈতিক দ্বন্দ্বেই উপনীত হয়। যদি কেহ মনে করেন, শত দুঃখকষ্ট সত্ত্বেও মানবজীবন এক আশ্চর্য প্রাপ্তি, কেবল বাঁচিয়া থাকাই বাঁচিয়া থাকিবার আশ্চর্য উপহার, তিনি বলিবেন, জন্ম দিয়াছে বলিয়াই তো ভাবিতে পারিতেছ বলিতে পারিতেছ রাগিয়া উঠিতে পারিতেছ। জন্মই না হইলে তোমার অস্তিত্বই থাকিত না, তাহা কেমন করিয়া কাঙ্ক্ষিত অবস্থা হয়? বিপরীতে কেহ বলিতে পারেন, যে গ্রহে পরিবেশ দূষিত, খাদ্য বিষাক্ত, জল রোগবাহী, মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত, ইতিহাস নিষ্ঠুর আখ্যানময়, সংবাদ হিংসাবাচক, সমাজ কুসংস্কারদীর্ণ, সংস্কৃতি লোভাক্রান্ত, সেইখানে একটি প্রাণীকে আনিয়া ছাড়িয়া দিবার মধ্যে হিংস্র সিংহের সম্মুখে নিরস্ত্র মানুষকে ফেলিয়া মজা দেখিবার দ্যোতনা পাওয়া যায়।

বহু ধর্মই নাকি বলিয়াছে, মানুষ তাহার কর্মফলে বারে বারে এই ধরায় ফিরিয়া আসে, মানুষের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সাধনা করিয়া মোক্ষ লাভ, যাহাতে এই জন্মচক্র হইতে নিস্তার লাভ করা যায় ও আর এই কর্দমাক্ত পঙ্কিল অস্তিত্বের ভার বহন না করিতে হয়। যদিও মেলা ও উৎসব, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ, নেটফ্লিক্স ও অ্যামাজ়ন, যৌনতা ও বৈভব, বিশ্বকাপ ও আইপিএল অধ্যুষিত বসুধায় এই প্রকারের চিন্তা বিরল, কিন্তু নিজ স্খলিত শিথিল কামনার ভার এবং সেই কামনা কখনও মিটিবে না সেই বোধের পুঁটলি বহিয়া ফিরিতে এক জন মানুষ অনাগ্রহ প্রকাশ করিতেই পারেন। তিনি যদি ফাঁকিবাজি হইতেও সেই মর্মে ক্ষোভ ও নালিশের অঞ্চলে ভ্রমণ শুরু করেন, তাহা সত্ত্বেও তাঁহার প্রশ্নের দার্শনিক ভিত্তি অস্বীকার করা যাইতে পারে না।

যৎকিঞ্চিৎ

বইমেলায় গিয়ে লোকে যদি খায়, অনেকেই রেগে যায়। পিঠেপুলি মেলায় গিয়ে কেউ যদি এক কোণে দাঁড়িয়ে বই পড়ে, তা হলে কিন্তু এত রাগ দেখা যায় না। তা ছাড়া, একটা লোক খাচ্ছে মানেই সে বই কেনেনি কিনবে না, কে বললে? পরম পাঠকেরও খিদে পায়। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথও খাওয়াদাওয়া করতেন। অনেকে খাদ্য তৈরিকে বই লেখার সমান মানের শিল্প বলেও ধরে। একটা বাজে পদ্যের চেয়ে একটা ভাল মশলা দোসার স্বাদ বহু গুণ। পেটকে নিচু করে নাক-উঁচু থাকা অপরাধ।

অন্য বিষয়গুলি:

Mumbai Bizzare Birth
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE